মাকড়সাভীতির মাত্রা বোঝানোর জন্যে আমি আমাদের তিন ভাইবোনের তিনটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
আমার ছোট বোন শেফু কলেজে অধ্যাপনা করে। একদিন রিকশা করে ক্লাসে যাচ্ছে, হঠাৎ রিকশা থেকে একটা মাকড়সা তার শাড়িতে উঠে পড়ল। সে লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে অসংখ্য মানুষের দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে শাড়ি খুলে দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, মাকড়সা! আমার শাড়িতে মাকড়সা! লোকজন হৃদয়হীন নয়। তারা শাড়ি থেকে মাকড়সা সরিয়ে হাতে শাড়ি তুলে দিল।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আমার ছোট ভাই ডঃ জাফর ইকবালকে নিয়ে। সে শিকাগো বাস-স্টেশনের টয়লেটে গেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করল ইউরিন্যালে সবুজ রঙের একটা বড়সড় মাকড়সা। সে বিকট একটা চিৎকার দিয়ে বের হয়ে এল। লোকজন দৌড়ে এল, পুলিশ ছুটে এল, সবার ধারণা কোনো ধুনটুন হয়ে গেছে।
এবার আমার নিজের কথা বলি। ঢাকা থেকে বরিশাল যাচ্ছি। বি এম কলেজে রসায়নশাস্ত্রের এম. এস-সি, পরীক্ষার এক্সটারন্যাল হয়ে। প্রথম শ্রেণীর একটি কেবিন রিজার্ভ করা। রাত দশটার মতো বাজে। হঠাৎ দেখি কেবিনের ছাদে বিশাল এক মাকড়সা পেটে ডিম নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। আমি ছিটকে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। দশ টাকা কবুল করে একজন ঝাড়ুদার নিয়ে এলাম। সে অনেক খুঁজেও মাকড়সা পেল না, কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে। কেবিনে আর ঢুকলাম না। যদি মাকড়সা আবার কোনো অন্ধকার কোণ থেকে তার হয়ে আসে। প্রচণ্ড শীতের রাত পার করে দিলাম ডেকে হাঁটাহাঁটি করে। সতবার মাকড়সার কথা মনে পড়ল ততবারই শিউরে উঠতে লাগলাম।
এই ভীতি আমরা ভাইবোনেরা জন্মসূত্রে নিয়ে এসেছি। হয়তোবা আমাদের র ছয়চল্লিশটির ক্রমোজমের কোনো-একটিতে কোনো গণ্ডগোল আছে যার কারণে এই অস্বাভাবিক ভীতি।
শৈশবে আমাকে ঘুম-পাড়ানোর জন্যে এই মাকড়সাভীতিও কাজে লাগানো হত।
অধিকাংশ শিশুর মতো আমারও রাতে ঘুম আসত না। মা বিরক্ত হয়ে মেজো চাচাকে বলতেন, ওকে ঘুম পাড়িয়ে আন।
মেজো চাচা আমাকে কোলে নিয়ে চলে যেতেন বাড়ির দক্ষিণে কাঁঠালগাছের কাছে। সেই কাঁঠালগাছে বিকটাকার মাকড়সা জাল পেতে চুপচাপ বসে থাকত। আমাকে সেইসব মাকড়সার কাছে নিয়ে গিয়ে বলা হত-ঘুমাও। না ঘুমালে মাকড়সা গায়ে দিয়ে দেব। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়তাম। এখন আমার ধারণা, ঘুম না, ভয়ে হয়তোবা অচেতনের মতো হয়ে যেতাম। কেউ তা বুঝতে পারত না। ভাবত ঘুম-পাড়ানোর চমৎকার অষুধ তাদের কাছে আছে।
এখন ভাবলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। না বুঝে বয়স্ক মানুষরা নিতান্তই অবোধ একটি শিশুর উপর কী ভয়াবহ নির্যাতনই-না চালিয়েছেন!
আমি ছেলেবেলার কথা লিখব বলে স্থির করার পর আমার সব আত্মীয়স্বজনকে চিঠি লিখে জানালাম—আমার ছেলেবেলা সম্পর্কে কেউ যদি কোনোকিছু জানেন আমাকে যেন লিখে জানান। আমার এই আহ্বানের জবাবে ছোট চাচা ময়মনসিংহ থেকে যে-চিঠি লিখলেন তার অংশবিশেষ এইরকম-হুমায়ূন শৈশবে বড়ই দুষ্ট প্রকৃতির ছিল। রাত্রিতে কিছুতেই ঘুমাইত না। তখন তাহাকে মাকড়সার কাছে নিয়া গেলে দুই হাতে গলা জড়াইয়া সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে অচেতন হইয়া যাইত। ইহার কি যে কারণ কে জানে।
কুয়া এবং মাকড়সা এ দুটি জিনিস বাদ দিলে আমার শৈশবকে অসাধারণ আনন্দময় সময় বলা যায়। আমার ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা। আজকালকার মায়েরা সন্তান চোখের আড়াল হলেই চোখ কপালে তুলে হৈচৈ শুরু করে দেন। আমাদের সময় অবস্থা ভিন্ন ছিল। শিশুদের খোঁজ পড়ত শুধু খাওয়ানোর সময়। তাদের পড়াশোনা নিয়েও বাবা-মাদের খুব দুশ্চিন্তা ছিল না। একটি শিশুশিক্ষা এবং ধারাপাতের চটি একটা বই এবং স্লেট-পেনসিল কিনে দিলেই বাবা-মারা মনে করতেন অনেক করা হল। বাকি পড়াশোনা ধীরেসুস্থে হবে, এমন তাড়া কিসের?
ক্লাস ওয়ান টুর পরীক্ষাগুলিতে ফার্স্ট হতে হবে এমন কোন কথা নেই। পাশ করে পরের ধাপে উঠতে পারলেই হল। না পারলেও ক্ষতি নেই, পরের বার উঠবে। স্কুলতো পালিয়ে যাচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটায় এক ধরনের ঢিলেঢালা ভাব।
এমনিতেই নাচুনি বুড়ি তার উপর ঢাকের বাড়ি। বাবা আদেশ জারি করলেন তার ছেলেমেয়েদের যেন পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো চাপ না দেয়া। পড়াশোনার জন্যে সারাজীবন তো পড়েই রইল, শিশুকালটা আনন্দে কাটুক। মহানন্দে সময় কাটতে লাগল। শিশুদে্র আনন্দের উপকরণ চারদিকে ছড়ানো। অতি তুচ্ছ বিষয় থেকেও তারা আনন্দ আহরণ করে। আমিও তাই করছি আমার মার কোলে তখন আমার ভাই ইকবাল। মা তাকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। আমার দিকে তাকানোর সময় নেই। আমি মনের আনন্দে একা একা ঘুরি। যা দেখি তা-ই ভালো লাগে। ক্লান্তিহীন হাঁটা? মাঝে মাঝে পথ হারিয়ে ফেলি। তখন একে তাকে জিজ্ঞেস করতে হয় মীরাবাজার কোন দিকে?
আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতেও বাসায় কাউকে কখনো চিন্তিত হতে দেখিনি দুপুরে খাবার সময় উপস্থিত থাকলেই হল। দুপুরের খাবার শেষ হবার পর আরও আনন্দ। মা দিবানিদ্রায়। ঝিমধরা দুপুর। আমি ঘুরছি নিজের মনের আনন্দে এই পর্যায়ে একজন আইসক্রিম ওয়ালার সঙ্গে আমার খাতির হয়ে গেল। তখনকার আইসক্রিমওয়ালারা দুহাতে দুটা আইসক্রিমের বাক্স নিয়ে মধুর গলায় ডাকত~~দুধমালাই আইসক্রিম, দুধমালাই।
দুরকম আইসক্রীম ছিল। দুপয়সা দামের সাধারণ আর এক আনা দামের অসাধারণ। আইসক্রীম খাবার পরম সৌভাগ্য মাসে একবারের বেশী হত না। হবার কথাও নয়। যাই হোক এমনি এক ঝিম ধরা দুপুরে চাই দুধমালাই আইসক্রিম শুনে ছুটে ঘর থেকে বের হলাম। আইসক্রীমওয়ালা বলল, আইসক্রিম কিনবে?।