মা বললেন, যে-জিনিস তোমার বাবা দেখে যেতে পারেননি, আমি তা দেখব।
আমি বললাম, আম্মা, আপনি কি হজে যেতে চান? যেতে চাইলে বলুন, ব্যবস্থা করি।
না।
ছোটবেলায় দেখেছি আপনি জরি দিয়ে তাজমহলের ছবি এঁকেছিলেন, তাজমহল দেখতে ইচ্ছা করে?
না। আমি একা একা কিছু দেখব না।
বাবা যেসব জিনিস খেতে পছন্দ করতেন তাঁর মৃত্যুর পর কোনোদিন সেই খাবার বাসায় রান্না করেননি। সেইসব খাবারের একটি হচ্ছে বুটের ডাল দিয়ে গোরুর গোশত। আর একটি-বরবটির চচ্চড়ি। আহামরি কোনো খাবার নয়।
আমি একবার বললাম, আমাদের জন্যে আপনার কি কোনো উপদেশ আছে?
তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, উপদেশ নয়, একটি আদেশ আছে। আদেশটি হচ্ছে–কেউ যদি কখনো তোমাদের কাছে টাকা ধার চায় তোমরা না বলবে না। আমাকে অসংখ্যবার মানুষের কাছে ধারের জন্যে হাত পাততে হয়েছে। ধার চাওয়ার লজ্জা এবং অপমান আমি জানি।
(অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলি) মার অসাধারণ-ইএসপি বা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা ছিল। প্রায় সময়ই ভবিষ্যতে কী ঘটনা ঘটবে তা হুবহু বলে দিতে পারতেন। মার এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা সম্পর্কে বাবা পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন। মাকে তিনি ঠাট্টা করে ডাকতেন মহিলা পীর। মার এই ক্ষমতা বাবার মৃত্যুর পরপরই পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।*
——
* আমার ছেলেবেলা গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর কী মনে করে জানি মা আমেরিকা যেতে রাজি হলেন। মাস সেখানে কাটিয়ে এসেছেন। কিছুদিন আগে আমাকে বললেন হজ করতে চান।
জোছনার ফুল
আমাদের বাসা ছিল সিলেটের মীরাবাজারে।
সাদা রঙের একতলা দালান। চারদিকে সুপারিগাছের সারি। ভেতরের উঠোনে একটি কুয়া। কুয়ার চারপাশ বাঁধানো। বাড়ির ডানদিকে প্রাচীন কয়েকটা কাঁঠালগাছ। কাঁঠালগাছের পাতায় আলো-আঁধারের খেলা। কুয়ার ভেতর উকি মারছে নীল আকাশ। একটু দূরে দুটো আতাফল গাছ। সোনালি রঙের আতাফলে পুরো গাছ সোনালি হয়ে আছে। পাকা আতার লোভে ভিড় করেছে। রাজ্যের পাখি। তাদের সঙ্গে ঝগড়া বেধে গেছে কাকদের। কান পাতা দায়। এমন একটা রহস্যময় পরিবেশে আমার শৈশবের শুরু। শুরুটা খুব খারাপ না। তবু শৈশবের কথা মনে হলেই প্রথমে কিছু দুঃখময় স্মৃতি ভিড় করে। কিছুতেই তাদের তাড়াতে পারি না। সেগুলো দিয়েই শুরু করি।
একদিন কী যেন একটা অপরাধ করেছি। কাপ ভেঙে ফেলেছি কিংবা পাশের ডির জানালায় ঢিল মেরেছি। অপরাধের শাস্তি দেয়া হবে। মা শাস্তির ভার নে আমার মেজো চাচাকে। তিনি আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। সিলেটে এম. & কলেজে আই. এ. পড়তেন এবং প্রতি বছর ফেল করতেন। মেজো চাচা আমাকে শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। আমাকে একহাতে শূন্যে ঝুলিয়ে কুয়ার মুখে ধরে বললেন, দিলাম ছেড়ে।
আমার সমস্ত শরীর ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। সত্যি যদি ছেড়ে দেন! নিচে গহিন কুয়া। একটা হাত ধরে আমাকে কুয়ার ভেতর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। মেজো চাচা মাঝে মাঝে এমন ভঙ্গি করছেন যেন আমাকে সত্যি সত্যি ছেড়ে দিচ্ছেন। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আর কোনোদিন করব না। আর কোনোদিন না।
আমার বয়স তখন কত? পাঁচ কিংবা ছয়। নিতান্তই শিশু। এরকম একটা শিশুকে কুয়ায় ঝুলিয়ে যে-ভয়ংকর মানসিক শাস্তি মেজো চাচা দিলেন তা ভাবলে আমি আজও আতঙ্কে নীল হয়ে যাই। লিখতে লিখতে চোখের সামনে সেই অতলস্পর্শী কুয়া ভেসে উঠছে। বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়েছে।
আমার মেজো চাচা কিংবা আমার মা দুজনের কেউই বুঝলেন না একটি শিশুকে এইভাবে মানসিক শাস্তি দেয়া যায় না। এটা অমানবিক। এ-ধরনের শান্তিতে শিশুর মনোজগতে বড় রকমের বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। বরং তারা দুজনই দেখলেন–আমি একটিমাত্র জিনিসকেই ভয় পাই, সেটা কুয়ায় ঝুলিয়ে ধরা। কাজেই বারবার আমাকে এই শাস্তি দেয়া হতে লাগল।
অসম্ভব দুষ্ট ছিলাম। নানানভাবে সবাইকে জ্বালাতন করতাম। শাস্তি আমার প্রাপ্য ছিল, কিন্তু এত কঠিন শাস্তি না, যে-শান্তি চিরকালের মতো আমার মনে ছাপ ফেলে যাবে।
আমাকে এই অমানবিক নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করে আমার ছোট বোন শেফু। তাকেও একদিন এই শাস্তি দেয়া হল। মেজো চাচা তাকে কুয়ার ভেতর ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন, দিলাম ছেড়ে।
সে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, দেন ছেড়ে।
চাচা বললেন, সত্যি সত্যি ছেড়ে দেব?
সে থমথমে গলায় বলল, ছাড়েন। আপনাকে ছাড়তে হবে।
শেফুর কথাবার্তায় আমার চাচা এবং মা দুজনই খুব মজা পেলেন। বাবা অফিস থেকে ফেরামাত্র তাকে এই ঘটনা বলা হল। বাবা অবাক হয়ে বললেন, এদের এইভাবে শাস্তি দেয়া হয়? কই, আমি তো জানি না! কী ভয়ংকর কথা! এই জাতীয় শাস্তির কথা আর যেন কোনোদিন না শুনি।
মা বললেন, এরা বড় যন্ত্রণা করে। তুমি তো বাসায় থাক না। তুমি জান না।
বাবা কঠিন গলায় বললেন, এ-ধরনের শাস্তির কথা আর যেন না শুনি।
শাস্তি বন্ধ হল, কিন্তু মন থেকে স্মৃতি মুছল না। কতদিন পার হয়েছে, অথম এখনও দুঃস্বপ্নের মতো গহিন কুয়াটার কথা মনে পড়ে। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, আমার এই চাচা শুধু শাস্তিদাতাই ছিলেন না, প্রচুর আদরও তাঁর কাছে পেয়েছি। আমার অক্ষরজ্ঞানও হয়েছে তাঁর কাছে।
কুয়ার হাত থেকে বাঁচলেও মাকড়সার হাত থেকে বাঁচলাম না। মাকড়সার ব্যাপারটি বলি। কোনো-এক বিচিত্র এবং জটিল কারণে আমাদের ছ ভাইবোনেরই ভয়ংকর মাকড়সাভীতি আছে। নিরীহ ধরনের এই পোকাটিকে দেখামাত্রই আমাদের সবার মনোজগতে একধরনের বিপ্লব ঘটে যায়। আমরা আতঙ্কে ঘৃণায় শিউরে উঠি, বমিভাব হয়, চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। মনোবিজ্ঞানীরা এই ভীতির নিশ্চয়ই একটা ব্যাখ্যা দেবেন। আমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই।