.
সেই সময়কার খবরের কাগজে আমাদের হলেরই একটি ছেলে বিজ্ঞাপন ছাপাল–সে কোন ধনী পিতার কন্যাকে বিবাহ করতে চায়। বিনিময়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ দিতে হবে। সেই ছেলেকে নিয়ে কত হাসাহাসি। কেউ ভেবেও দেখল না কি গভীর বেদনায় সে পয়সা খরচ করে ঐ বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
চারতলায় থাকতেন এক মৌলানা সাহেব। তার কথা মনে পড়ে। অতি ভদ্রলোক। দেখা হলেই হাসিমুখে নানান খবর জিজ্ঞেস করবেন। ভদ্রলোক ছিলেন মৌলানায়ে মুহাদ্দেস। সম্ভবত আরবী পড়তেন। তিনি একটা পাখি পুষেছিলেন। খাঁচায় বন্দি সেই পাখির যত্ন ছিল দেখার মত। পাখিটি অতিরিক্ত যত্নের কারণেই বোধহয়–মারা গেল। মৌলানা দীর্ঘ একটি শের (কবিতা) রচনা করলেন। যার প্রথম চরণ–
মেরা বুলবুল মর গিয়া।
যার সঙ্গেই দেখা হয় তাকেই ধরে ধরে দীর্ঘ কবিতা শুনিয়ে অশ্রুবর্ষণ করেন।
সপ্তাহখানেক পর তাঁর আত্মীয়স্বজনরা খবর পেয়ে তাকে দেশের বাড়ি নিয়ে গেল। কারণ পাখির শোকে তিনি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। এই মৌলানা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন নি।
*
মহসিন হলের ছতলার একটা ঘর ছিল ভূতে-পাওয়া। বাইরে থেকে তালাবন্ধ কিন্তু ভেতর থেকে গুনগুন গানের শব্দ পাওয়া যায়। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় কে যেন স্যান্ডেল পায়ে হাঁটে। রহস্য ভেদ হল দীর্ঘদিন পর। হাউস টিউটররা এক রাতে সেই ঘরে ঢুকে কাবার্ড খুলে রূপবতী এক তরুণীকে আবিষ্কার করলেন। স্যাররা হতভম্ব। জানা গেল মেয়েটি এই রুমের বাসিন্দা স্ট্যাটিসটিকস পড়ে জনৈক ছাত্রের স্ত্রী। দুজনে গোপনে বিয়ে করেছে। দুজনের বাবা-মাই তাদের বের করে দিয়েছে। বেচারা স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় যাবে! হলে এনে লুকিয়ে রেখেছে কাবার্ডে। এইখানেই এই অসহায় মেয়েটি ছমাস ছিল। দেশের এবং দেশের বাইরের কিছু সংবাদপত্রেও ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। যেসব মাস্তানরা মেয়ে নিয়ে এসে জঘন্য কীর্তি-কাহিনী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কিছুই বলে না। কিন্তু অসহায় এই ছেলেটিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছরের জন্যে বহিষ্কার করা হয়।
.
১৯৬৯ সন। হলের টিভি রুমে আমরা বসে আছি অনেক রাত। রেডিও বাজছে। রানিং কমেট্রি হচ্ছে। অসম্ভব নাটকীয় একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। মানুষ নামছে চাঁদে। আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছি–সত্যি কি নামতে পারবে? এই
তো, এইতো নামল। আমরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম। আনন্দে দুটা চেয়ার ভাঙা হল। জানালার সব কটা কাঁচ ভাঙা হল। একজন উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে অচেতন হয়ে পড়ে গেল। তাকে বাতাস করা হচ্ছে, মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। কি অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
*
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড লেগেই থাকতো। কবিতা পাঠের আসর, গল্প পাঠ, রবীন্দ্র জন্মোৎসব–কিছু না কিছু আছেই। ছাত্রদের প্রবল উৎসাহ। প্রাণশক্তিতে ছেলেরা যে ঝলমল করছে তা স্পষ্ট বোঝা যেত। উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানে সেই প্রাণশক্তির পূর্ণ প্রকাশ দেখলাম। জীবনকে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কত তুচ্ছ মনে করে তা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। গুলি হচ্ছে নীলক্ষেতে–কারফিউ চলছে। সেই কারফিউ অগ্রাহ্য করে মহসিন হলের ছেলেরা ছুটে গেল। গুলিবিদ্ধ দুটি মানুষকে হলে নিয়ে এল। তখন গভীর রাত। মানুষ দুটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমরা ভীত চোখে দেখছি।
এদের চিকিৎসা প্রয়োজন–কারফিউর ভেতরই ছেলেরা এদের নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। এই স্মৃতি কি করে ভুলি?
আরেকটি কথা না বললে রচনা অসম্পূর্ণ থাকবে। আমার লেখালেখি জীবনের শুরু হয় মহসিন হলে। ৫৬৪ নম্বর রুমেই রাত জেগে জেগে লিখে ফেলি প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাস–নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার। যাত্রা শুরু করি অচেনা এক পথে। সেই পথ দুঃখ ও আনন্দময়।
বছর পাঁচেক আগে মহসিন হলে গিয়েছিলাম। রাত দশটার মত বাজে। চুপি চুপি ৫৬৪ নম্বর রুমের সামনে দাড়িয়ে দরজায় টোকা দিলাম। এক ছেলে দরজা খুলে ভয়ংকর গলায় বলল, কি চাই?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, রং নাম্বার। ভুল জায়গায় এসেছি।
পুরানো তীর্থক্ষেত্র দেখার শখ ছিল। দেখা হল না।
তীব্র কৌতূহল
দুটি জিনিস দেখার জন্যে আমার তীব্র কৌতূহল ছিল।
মানুষের জন্ম এবং মৃত্যু। পৃথিবীতে আসা এবং পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার দৃশ্য। জন্মদৃশ্য দেখা তো একেবারেই অসম্ভব। সামাজিক কারণেই পুরুষের পক্ষে জন্মসময়ে উপস্থিত থাকা অকল্পনীয় ব্যাপার।
মৃত্যুসময়ে উপস্থিত থাকাটা সেই তুলনায় অত্যন্ত সহজ। এই সহজ ব্যাপারটি আমার জীবনে ঘটছিল না। আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি। চূড়ান্ত অসুস্থ অবস্থায় দেখতে গিয়েছি। কিন্তু মৃত্যুর সময়টিতে কখনো কাউকে দেখিনি।
এক ডাক্তার বন্ধু হাসপাতালে কাজ করে। তাকে আমি আমার গোপন ইচ্ছার কথা বললাম। সে এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমি একজন মানসিক রুগী। রুক্ষ গলায় বললো, মানুষের মৃত্যু দেখার কি আছে? এটা তো কোন নাটক না। তুমি কোন একটা অপারেশন দেখতে চাও, আমি ব্যবস্থা করে দি।
মানুষকে কাটা-ছেড়া করার দৃশ্য দেখার ব্যাপারে আমি কোন রকম আগ্রহ বোধ করলাম না। তাকে বলে রাখলাম, হাসপাতালে তো প্রায়ই রুগী মারা যায়। তোমরা ডাক্তার হিসেবে নিশ্চয়ই টের পাও রুগীটি কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবে। এ-রকম দেখলে টেলিফোন করে দিও। আমি সঙ্গে সঙ্গে চলে আসব। আমি শুধু একবারই দেখতে চাই।