পুরোটাই হাতের কৌশল। খুবই প্র্যাকটিস দরকার। আমি দরজা বন্ধ করে প্র্যাকটিস করি। নিরলস সাধনা যাকে বলে। এর চেয়ে অনেক কম সাধনায় ঈশ্বর ধরা দেন। মহসিন হলের প্রধান হাউস টিউটর তখন অধ্যাপক এমরান। তিনি একদিন জরুরি চিঠি পাঠিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন আছে।
কি কমপ্লেইন স্যার?
ঘর বন্ধ করে তুমি নাকি সারারাত কিসব কর। ঝনঝন শব্দ হয়। কেউ ঘুমুতে পারে না। তুমি কি কর?
স্যার, ম্যাজিক শিখি।
তুমি কি ম্যাজিক শেখার জন্যে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছ? এটা কি ম্যাজিকের স্কুল? খবর্দার, আর যেন ঝনঝনানি না শুনি। আর একবার ঝন-ঝন হলে সীট ক্যানসেল। মনে থাকে যেন।
আমি বিমর্ষমুখে রুমে ফিরে এলাম। তবে প্র্যাকটিস বন্ধ হল না। কৌটার নিচে তূলা দিয়ে প্র্যাকটিস চালাতে লাগলাম। যথাসময়ে টিভি অনুষ্ঠান হয়ে গেল। তখন টিভি ছিল ডিআইটি ভবনে। সব প্রগ্রাম হত লাইভ। আমার নিজের অনুষ্ঠান নিজে দেখতে পেলাম না। তাতে আমার আনন্দের কমতি হল না। স্টুডিও থেকে বের হয়ে মনে হল সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে তরুণ জাদুকরকে।
আমার কোন নেশা দীর্ঘস্থায়ী হয় না–এটা হয়ে গেল। মানুষকে বিস্মিত করতে পারার আলাদা আনন্দ আছে। সেই আনন্দে বুদ হয়ে রইলাম। কেমিস্ট্রি পড়া চালিয়ে যাচ্ছি–চালাতে হয় বলেই চালানো। ডিপার্টমেন্টের স্যাররা প্রায়ই বলেন, __ হুমায়ূন, বাসায় জন্মদিনের পার্টি আছে, ম্যাজিক দেখিয়ে যাও। আমি মহা উৎসাহে রিকশায় করে বাক্স-টাক্স নিয়ে রওনা হই। একদিন ঢাকা জুট মিলে ম্যাজিক দেখিয়ে দুশ টাকা পেলাম। একশ চলে গেল যন্ত্রপাতির ভাড়ায়। একশ লাভ।
মহসিন হলে যে ঘরে আমি থাকি সেখানে খাঁচায় চারটা কবুতর এবং একটা টিয়া পুষি। ম্যাজিকে কবুতর, টিয়া এসব লাগে। আমার একটাই স্বপ্ন–ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানস-এর সদস্য হব। এই সদস্যপদের জন্যে আকাঙ্ক্ষার কারণ হল ঢাকায় দুজন জার্মান জাদুকর এসেছিলেন। দুজনই ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানস-এর সদস্য। তাঁরা হোটেল শাহবাগে জাদু দেখিয়ে সবাইকে চমৎকৃত করেছেন। আমি নিজে হয়েছি স্তম্ভিত। তখন আর্থিকভাবে খুব অসহায় অবস্থা সত্ত্বেও দুবার তাদের শো দেখলাম। নেশা লেগে গেল। কঠিন নেশা।
এখন বলি নেশা কি করে কাটল সেই গল্প। নেশা পুরোপুরি কেটে গেল আমার বাসর রাতে। বালিকাবধূকে মুগ্ধ করার জন্য রাত তিনটার দিকে তাকে ম্যাজিক দেখাতে শুরু করলাম। হয়ত খুব সাবধান ছিলাম না কিংবা নবপরিণীতা স্ত্রীর সামনে নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম–দড়ি কাটার খেলাটা সে ধরে ফেলল এবং খুব হাসতে লাগল। দ্বিতীয় খেলাটায়ও একই অবস্থা।
মেয়েটি তার স্বামীকে চূড়ান্ত রকমের অপদস্ত করল। সে তা বুঝতেও পারল। আমি তৃতীয় ম্যাজিক দেখাতে যাচ্ছি। সে বলল, রাখুন তো আপনার ম্যাজিক, এইসব কি শুরু করেছেন? রাত বাজে তিনটা।
ঐ রাতেই আমার শেষ ম্যাজিক শো হল। আর কখনো ম্যাজিক দেখাই নি বা দেখাতে উৎসাহ বোধ করি নি।
বিয়ের দশ বছর পর গুলতেকিন হঠাৎ করে বলতে শুরু করল–বাসর রাতে আমি খুব বোকামি করেছি। আমার উচিত ছিল বিস্মিত হবার ভান করা। সরি, তোমাকে ঐ রাতে খুব লজ্জা দিয়েছি। বয়স কম ছিল। বুঝতে পারি নি যে তুমি এত আগ্রহ করে আমাকে বিস্মিত করার চেষ্টা করছ। এখন একবার ম্যাজিক দেখাও–দেখ, আমি কি পরিমাণ মুগ্ধ হই। ম্যাজিকের কৌশল ধরার চেষ্টা করব না–চেষ্টা করব বিস্মিত হবার। বিয়ের পর পনেরো বছর হয়েছে। পনেরো বছরে কোন ম্যাজিক দেখাই নি। তার পরেও কিম আশ্চর্যম! হঠাৎ ইংল্যাণ্ড থেকে চিঠি এসে উপস্থিত–আমাকে ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানস এর সদস্যপদ দেয়া হয়েছে। এই অতি আশ্চর্য ঘটনা সম্ভব হয়েছে আমার জাদুকর বন্ধু জুয়েল আইচের কারণে। এই ভালমানুষটি আমাকে বিস্মিত করবার সুন্দর ব্যবস্থাই করে রেখেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব ম্যাজিসিয়ানের চিঠিটি এসে পৌঁছল আমার জন্মদিনে। কাকতালীয় ব্যাপার তো বটেই। মাঝে মাঝে কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে বলেই আমাদের এই জীবন এবং এই পৃথিবী এত মজার।
১৯৬৭ সন। শীতের সকাল
১৯৬৭ সন। শীতের সকাল। রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যানের ঘরে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছি। ঘরটা প্রকাণ্ড হলেও অন্ধকার। দিনের বেলাতেও আলো জ্বলছে। সেই আলো অন্ধকারে প্রথম যা চোখে পড়ছে তা হল অপরিচিত একজন মানুষের তৈলচিত্র। মানুষটি রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। যেন পৃথিবীর সবার উপরেই তিনি বিরক্ত। ক্যামিকেলস-এর গন্ধে আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। ঘরে কোন ধোয়া নেই, তবু মনে হচ্ছে কাঠ-কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়ায় ঘর ভরে আছে।
চেয়ারে ছোটখাট একজন মানুষ বসে আছেন–তিনিই খোন্দকার মোকাররম হোসেন। চোখে ভারী চশমা। তার মুখ হাসি হাসি, তবে সেই হাসি থেকে কেন জানি কোন ভরসা পাওয়া যায় না বরং ভয় লাগে। তিনি নরম গলায় বললেন, তুমি কেমিস্ট্রি পড়তে চাচ্ছ কেন?
আমি উত্তর দিলাম না। কারণ আমার মনে হল না তিনি কোন উত্তর শুনতে চাচ্ছেন। প্রশ্ন করতে হয় বলেই করা। প্রশ্ন করেই তিনি পাশে বসা অন্য একজন শিক্ষকের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলা শুরু করেছেন।