মা পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে লজ্জায় কাঁপছি। আমার ছোটবোন এসে বলল, দাদাভাই, তুমি ভাবীকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে চলে যাও। এই নোংরা ব্যাপারটা ভাবীর সামনে না হওয়াই ভাল। তাড়াতাড়ি কর। পুলিশ ঘরে ঢুকে পড়ার আগেই কর।
আমি গুলতেকিনকে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। বৈশাখ মাসের ঘন নীল আকাশ, পেঁজাতূলার স্তূপীকৃত মেঘ, চনমনে রোদ। আমরা রিকশা করে যাচ্ছি। হুড ফেলে দিয়েছি। আমার মনের গোপন ইচ্ছা–পৃথিবীর সবাই দেখুক, এই রূপবতী বালিকাটিকে আমি পাশে পেয়েছি। গভীর আনন্দে আমার হৃদয় পূর্ণ। বাসায় এখন কি হচ্ছে তা এখন আমার মাথায় নেই। ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়েও ভাবছি না। বর্তমানটাই সত্যি। অতীত কিছু না–ভবিষ্যৎ তো দূরের ব্যাপার। আমরা বাস করি বর্তমানে–অতীতেও না, ভবিষ্যতেও না।* ———-
*শহীদ পরিবার হিসেবে পাওয়া ঐ বাড়ি থেকে পুলিশ আমাদের বের করে দিয়েছিল। আমরা একটি রাত কাটিয়েছিলাম খোলা আকাশের নিচে। খুব মন্দ কাটে নি। আকাশ ছিল তারা ভরা।
উনিশশো পঁয়ষট্টি সন
আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। উনিশশো পঁয়ষট্টি সন–একটা স্যুটকেস এবং হোল্ডঅল নামক বস্তুতে লেপ-তোষক ভরে ঢাকা কলেজের সাউথ হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আজ আমাকে সীট দেয়া হবে। একটু ভয় ভয় লাগছে কারণ শুনতে পাচ্ছি যত ভাল রেজাল্টই হোক সবাইকে সীট দেয়া হবে না। যাদের দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে বলে মনে হবে হোস্টেল সুপার তাদের বাতিল করে দেবেন। তাঁর কথাই শেষ কথা। আপীল চলবে না।
আমি দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে নই। কিন্তু চেহারায় সেই ব্যাপারটা আছে কি-না বুঝতে পারছি না। চেহারা দেখে যদি আমাকে দুষ্ট প্রকৃতির মনে হয় তাহলে তো সর্বনাশ! আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি চেহারায় এক ধরনের গোবেচারা ভাব ফুটিয়ে তুলতে।
সুপারের ঘরে ডাক পড়ল। সুপার একবারো আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, ২০৬ নম্বর রুম। জানালার কাছের সীট। কোন ফাজলামী বদমায়েশী করা চলবে না। প্রতিদিন সন্ধ্যায় রোল কল হবে। রোল কলের সময় যদি পরপর দুদিন সীটে না পাওয়া যায় তাহলে সীট ক্যানসেল। মনে থাকবে?
জি স্যার, থাকবে।
ভাল ভাল ছেলে ঢাকা কলেজে পড়তে আসে। অল্প কিছু ভাল থাকে, বেশির ভাগই বাঁদর হয়ে যায়। কথাটা যেন মনে থাকে।
মনে থাকবে স্যার।
হোস্টেল ফিস দাও। এক মাসের খাবার বাবদ ৩৮ টাকা। সীট ভাড়া পাঁচ টাকা, অন্যান্য ফী পাঁচ টাকা। মোট আটচল্লিশ।
আমি আটচল্লিশ টাকা দিয়ে ঢাকা কলেজ সাউথ হোস্টেলে ভর্তি হয়ে গেলাম। আতংকে বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে জেলখানা। এর আগে কখনো বাবা, মা, ভাইবোন ছেড়ে এত দূরে থাকি নি। কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। কলেজের ছাত্র, কাঁদলে সবাই হাসাহাসি করবে। চোখের পানি আসি-আসি করেও আসছে না।
সেই সময়ে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন জালালুদ্দিন __। কড়া লোক। তার আইন-কানুন বড়ই কঠিন। তৃতীয় দিনেই তার পরিচয় পেলাম। নর্থ হোস্টেলের এক ছাত্র সেকেণ্ড শো সিনেমা দেখে হোস্টেলে ফিরছিল। কপালের ফেরে বেচারা প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সামনে পড়ে গেল। স্যার শীতল গলায় বললেন, কাল ভোর দশটার আগেই তুমি হোস্টেল ছেড়ে চলে যাবে। তুমি দুষ্ট গরু। দুষ্ট গরু আমি গোয়ালে রাখব না।
দুষ্ট গরুকে পরদিন সকাল নটায় কাঁদতে কাঁদতে রিকশায় বেডিংপত্র তুলে চলে যেতে দেখা গেল। তাকে তখন মোটেই দুষ্ট গরু মনে হচ্ছিল না।
আমরা সবাই সাবধান হয়ে গেলাম। নিঃশ্বাস ফেলতেও সাবধানে ফেলি। প্রিন্সিপ্যাল স্যার যদি আবার নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনে ফেলেন। প্রচণ্ড পড়াশোনার চাপ। রাতে রোল কল। মাঝে মাঝে গভীর রাতে চেকিং। ভয়াবহ অবস্থা। এর মধ্যে সপ্তাহটা কোনদিকে যায় বুঝতেই পারি না–সমস্যা হয় ছুটির দিনে। ছুটির দিন আর কাটতে চায় না। ছুটির দিন আইন কানুন কিছু দুর্বল থাকে। রাত নটার সময় প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সামনে পড়ে গেলে তিনি শুধু কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করেন–কি নাম? হুজুর বাহাদুরের কি নাম? এই পর্যন্তই। পরদিন সকালে বিছানা-বালিশ নিয়ে চলে যেতে হয় না। ছুটির দিনে হোস্টেলের ছাত্ররা আত্মীয়স্বজনের বাসায় যায়। কেউ কেউ যায় বলাকা সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে। আইয়ুব খানের কল্যাণে তখন ছাত্রদের সিনেমা দেখা খুব সহজ। ছাত্র হলে সরকারী ট্যাক্স দিতে হয় না। টিকিটের দাম অর্ধেক। মুশকিল হচ্ছে ঢাকায় তখন আমার কোন আত্মীয়স্বজন নেই। অর্ধেক দামে সিনেমার টিকিট কেনার মত পয়সাও নেই। সময় কাটানোর জন্যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো শুরু করলাম। সকাল বেলা বেরিয়ে পড়ি। দুপুরের আগে হোস্টেলে ফিরে ভাত খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি। ফিরি সন্ধ্যা মেলাবার পর।
এরকম ঘুরতে ঘুরতেই মুখলেসুর রহমান নামের একজনের দেখা পেলাম। তার পেশা অদ্ভুত। ম্যাজিক দেখায়। এবং টাকার বিনিময়ে ম্যাজিকের কৌশল বলে দেয়। ম্যাজিকের যন্ত্রপাতি বিক্রি করে। অপূর্ব সব ম্যাজিক। তাকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যেই সে দেখাচ্ছে চারটা টেক্কা। নিমিষেই চার টেক্কা হয়ে গেল চার বিবি। এখানেই শেষ নয়—ফুঁ দেয়া মাত্র চার বিবিও অদৃশ্য। বিবির জায়গায় শাদা তাস। মুখলেসুর রহমান __ রেখে বিড়ি ধরিয়ে বলল, কেউ যদি এই তাস কিনতে চান __ মাত্র পাঁচ টাকা। আর যদি শুধু কৌশল জানতে চান, তিন টাকা।