আমি মটকা মেরে পড়ে থাকি, জবাব দেই না।
আনিস ভাই আরো কয়েকবার দরজায় টোকা দিয়ে শেষটায় বলেন–এখন কিন্তু দরজা ভাঙব। ওয়ান-টু-থ্রী
আমি কাতর গলায় বলি, আমার ভোর বেলায় ক্লাস আনিস ভাই।
ভোরবেলায় তো আমারো ক্লাস। হু কেয়ার্স?
যাবেন কোথায় এত রাতে?
প্রথমে নীলখেতে গিয়ে চা খাব, তারপর শহরে হাঁটব।
শার্ট গায়ে দিয়ে বের হই। নীলখেতে চা খাই তারপর হাঁটতে শুরু করি। সেই সময় রাতের ঢাকা ছিল অসম্ভব নিরাপদ। শহর কখনো ঘুমুতো না। রাস্তা-ঘাটে কিছু না কিছু মানুষ থাকতোই। এমনও হয়েছে আমরা সারারাত হেঁটে ভোরবেলা হলে উপস্থিত হয়েছি। চা-নাশতা খেয়ে চলে গিয়েছি ক্লাসে।
দেশের প্রতি প্রচণ্ড মমতা ছিল আনিস ভাইয়ের। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের জন্যে কি করা যায়–কি করে এ দেশের শিল্প-সাহিত্যকে এগিয়ে নেয়া যায়–রাতদিন এই পরিকল্পনা। আহমেদ ছফার সঙ্গে যোগ দিয়ে তখন পত্রিকা বের করছেন। দারুণ উৎসাহ। ছবির একটা স্ক্রীপ্ট লিখে ফিললেন। যখন টাকা হবে এই ছবি বানানো হবে। দেশে বিদেশে ছবি যাবে সবাই মুগ্ধ হয়ে বলবে–বাংলাদেশের ছবি। যে দেশের প্রতি এত মমতা সেই দেশের উপর প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে তিনি ১৯৭৫ সনে চিরদিনের জন্যে চলে গেলেন কানাডা। আমার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখলেন না। চিঠি লিখি, জবাব দেন না।
আমেরিকা গিয়ে অনেক চেষ্টা করে টেলিফোনে তাঁকে পেলাম। মনে হল, কথা বলায় কোন আগ্রহ বোধ করছেন না। রাগ করে টেলিফোন রেখে দিলাম। সেও অনেক কাল আগের কথা।
তার পরের ঘটনা ভয়ংকর ধরনের। গভীর রাতে টেলিফোন এসেছে। লং ডিসটেন্স কল। আনিস ভাই আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আমাকে খুঁজে বের করেছেন। টেলিফোন করেছেন রাত তিনটায়। রাগ ভুলে গিয়ে আমি হাসিমুখে বললাম, আপনার পুরানো অভ্যাস এখনো যায় নি। টেলিফোন করেছেন, রাত তিনটায়।
আনিস ভাই হাসতে হাসতে বললেন, ইচ্ছে করে করেছি। তোমার ঘুম নষ্ট করবার জন্যে করেছি। কেমন আছ?
ভাল। আপনি কেমন?
আমি কেমন আছি বলছি, তবে শান্ত হয়ে শুনবে, মন খারাপ করবে না। আমার ক্যানসার হয়েছে। থ্রোট ক্যানসার। কাউকেই বলি নি। তোমাকে বললাম। সময় হাতে বেশি নেই। দুমাস।
আমি টেলিফোন হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।
শেষ দুমাসে আনিস ভাই প্রতি সপ্তাহে টেলিফোন করতেন। রাত দুটা বা তিনটায় টেলিফোন বেজে উঠতো। কথা বলতে তখন তাঁর কষ্ট হত। সব কথা বোঝাও যেত না।
হুমায়ুন, তোমার কি মনে আছে আমরা কেমন সারারাত শহরে হাঁটতাম?
মনে আছে।
তুমি কি এখনো হাঁট?
না।
মৃত্যুর আগে আর একবার শুধু ঢাকা শহরে হাঁটতে ইচ্ছে করে। আমাদের দেশটাকে আল্লাহ এত সুন্দর করে কেন বানালেন বলতো? খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
চলে আসুন।
চলে আসা সম্ভব নয়। আমার শেষ অবস্থা। তুমি কি কাঁদছ নাকি?
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, না। আপনি দয়া করে আর আমাকে টেলিফোন করবেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না।
আনিস ভাই আমাকে টেলিফোন করেন নি। তাঁর নির্দেশমত হাসপাতাল থেকে তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমাকে দেয়া হয়।
আমি এখনো নিশিযাপন করি। মাঝে মাঝে কেমন জানি লাগে। মনে হয় হারিয়ে যাওয়া মানুষরা যেন হারিয়ে যায় নি–আছে, আমার পাশেই আছে। এই তো ভালবাসা এবং মমতায় তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এমন অনুভূতি কখনো দিনে হবার নয়–তার জন্যে প্রয়োজন চিররহস্যময়ী–রাত্রি। অনন্ত অম্বর।