লেখালেখির সময়ও একই ব্যাপার–যে সব চরিত্র তৈরি করি তাদের মানবিক গুণই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তাদের চরিত্রের অন্ধকার অংশের কথা ভাবতে বা লিখতে ভাল লাগে না। লিখতে গেলে মনের উপর চাপ পড়ে।
মানুষকে বড় করে দেখার এই প্রবণতা কি দোষণীয়?
যে যেমন তাকে ঠিক তেমন করেই কি দেখা উচিত নয়? আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয় মানব চরিত্রে এমন সব বড় দিক আছে যার স্পর্শে তার যাবতীয় দোষ, যাবতীয় ত্রুটি ঢাকা পড়ে যায়।
প্রাণী হিসেবে মানুষ অসম্ভব বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রধান লক্ষণ হচ্ছে, সে কখনো নিজের জীবন বিপন্ন করবে না। সে তার জীবনের মূল্য জানে। এই জীবনকে সে রক্ষা করবে। অথচ কি মজার ব্যাপার, অসম্ভব বুদ্ধিমান প্রাণী হয়েও মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকাণ্ড সব বোকামি করে। দাউদাউ করে একটা বাড়িতে আগুন জ্বলছে। বাড়ির ভেতর থেকে ছোট্ট একটা শিশুর কান্না শোনা যাচ্ছে। নিতান্তই অপরিচিত একজন মানুষ শিশুর কান্না শুনে দৌড়ে আগুনের ভেতর ঢুকে পড়বে। ভয়াবহ বোকামি করে প্রমাণ করবে যে মানুষ শ্রেষ্ঠতম প্রাণী।
আমাদের নানার বাড়িতে নসু বলে একটা লোককে ছোটবেলায় দেখেছিলাম। তার সমস্ত শরীর ঝলসানো। সে আগুনে আটকা পড়া একটা বিড়াল ছানাকে বাঁচাতে গিয়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল। সবাই তাকে ডাকতো বোকা নসু। কিন্তু সেই বোকা ডাকের সঙ্গে কি গভীর মমতাই না মেশানো থাকতো!
ছোটবেলায় আমি ভেবেছিলাম, নসু মামা বোধ করি খুব বিড়াল পছন্দ করেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি দাঁত-মুখ কুঁচকে বললেন, দূর ভাইগনা। বিলাই আমার দুই চউক্ষের বিষ।
আশ্চর্যের ব্যাপার, এই দুচোখের বিষের বাচ্চা বাঁচানোর জন্যেও আগুনে ঝাপিয়ে পড়া যায়। মানুষ বলেই সে পারে। মানুষকে চেষ্টা করে মহৎ হতে হয় না, মহত্ত্ব নিয়েই সে জন্মেছে।
আমার মন যখন বিক্ষিপ্ত থাকে তখন কিছু কিছু লেখকের রচনা পাঠ করি যা আমাকে শান্ত হতে সাহায্য করে। মার্কিন ঔপন্যাসিক জন স্টেইনবেক তেমনি একজন লেখক। মানুষের শুভবুদ্ধির প্রতি তাঁর আস্থা, মানুষের প্রতি তাঁর সীমাহীন মমতা আমাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে।
১৯৫২ সনে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে জন স্টেইনবেক যে ভাষণ দিয়েছিলেন আমার কাছে সে ভাষণ দৈববাণীর মত মনে হয়। স্টেইনবেক বলছেন–আমি মনে করি যে লেখক মানুষের নিখুঁত ও ত্রুটিহীন হয়ে উঠবার সম্ভাবনায় আস্থা স্থাপন করেন না–সাহিত্যের প্রতি তাঁর কোন আনুগত্য নেই। সাহিত্য সদস্য হবার কোন যোগ্যতা তাঁর নেই।
এই মহান লেখক মানুষের ত্রুটিগুলি এত মমতায় এঁকেছেন যে পড়তে পড়তে বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে। মনে হয়, বিশ্বাস হারানোর সময় এখনো আসে নি। কখনো আসবেও না।।
আমার যখন রাতজাগা রোগ হয় তখন এই লেখকের দুটি বই খুব আগ্রহ করে পড়ি–একটি হল ক্যানারী রো। কয়েকজন ভবঘুরে অলস যুবকের গল্প। অন্যটি টরটিলা ফ্ল্যাট। বড়ই মজার, বড়ই রহস্যময় উপন্যাস। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছি, যে গ্রন্থের জন্যে তিনি নোবেল পুরস্কার পান–গ্রেপস অব র্যাথ তা আমার পড়তে একেবারেই ভাল লাগে নি। একবার শুধু পড়েছি। তাও কষ্ট করে।
এই মহান লেখক তাঁর আত্মজীবনীতে খুব মজা করে একটা ঘটনা লিখেছেন। হাতের কাছে বইটি নেই। কাজেই হুবহু অনুবাদ করতে পারছি না–ঘটনাটা বলি। যুবক বয়সে স্টেইনবেকের খুব ইচ্ছে হল আমেরিকার এক মাথা থেকে পায়ে হেঁটে অন্য মাথায় যাবেন। কাঁধে হেভার স্যাক নিয়ে নিঃস্ব অবস্থায় যাত্রা শুরু করলেন। সারাদিন হাঁটেন। রাতে কোন না কোন বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। গৃহকর্তা জিজ্ঞেস করেন, তোমার উদ্দেশ্য কি? যাচ্ছ কোথায়?
আমি পায়ে হেঁটে আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাচ্ছি।
কেন?
এমি, কোন কারণে না।
না, তোমার মতলব সুবিধার মনে হচ্ছে না। থাকতে দেয়া হবে না। অন্য কোথাও যাও।
অন্য বাড়িতে গিয়েও দেখেন একই অবস্থা। একটা যুবক ছেলে শুধুমাত্র শখের কারণে ছহাজার মাইল পায়ে হাঁটবে–এটা কেউ বিশ্বাস করছে না। স্টেইনবেক বলছেন, আমি যখন দেখলাম, মানুষ সত্যটাকে গ্রহণ করতে পারছে না তখন মিথ্যার আশ্রয় নিলাম–আমি বলা শুরু করলাম, বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরেছি। পায়ে হেঁটে আমেরিকার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাব। তখন সবাই যে শুধু আমার কথা বিশ্বাস করল তাই না, আমাকে নানানভাবে উৎসাহও দিল যাতে আমি বাজি জিততে পারি। স্টেইনবেক বলছেন, মানব চরিত্রের একটি মজার দিক হচ্ছে মানুষ সত্যের চেয়ে মিথ্যাকে সহজে গ্রহণ করে।
প্রসঙ্গ থেকে সরে এসেছি। প্রসঙ্গে ফিরে যাই–নিশি যাপন বিষয়ে বলছিলাম। আজ রাত জেগে আছি মন খারাপের জন্যে ঘুম আসছে না বলে। কিন্তু আমার মন যখন বেশ ভাল থাকে তখনো আমি মাঝে মাঝে নিশি যাপন করি।
এই পৃথিবীতে সবচে মহৎ এবং সবচে ভয়ংকর পরিকল্পনাগুলি নাকি রাতে করা হয়। সাধুরা ঈশ্বর চিন্তা করেন রাতে। কুৎসিততম অপরাধগুলি করতে অপরাধীরা রাতে বের হয়। সাধারণ মানুষদের জন্যে রাত হচ্ছে বিশ্রামের কাল। আর যারা অসাধারণ, রাত তাদের জেগে থাকার সময়। আমি খুবই সাধারণ তবু মাঝে মাঝে অসাধারণ হতে ইচ্ছা করে। রাত জাগতে ভাল লাগে। আমার এই রাতজাগা অভ্যেস ধরিয়ে দেন আনিস সাবেত। মেট্রিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া তুখোড় ছাত্র। মহসিন হলে আমার পাশের ঘরে থাকতেন। পদার্থবিদ্যার ছাত্র। তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা একটাই–ছবি বানাবেন। পাঠ্যবই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ছবি বানানোর কিছু কোর্স নিলেন। কোন এক ক্যামেরাম্যানের অ্যাসিসটেন্ট হয়ে ক্যামেরার কাজ শিখতে লাগলেন। তাঁর ছিল রাতজাগা নেশা। এই নেশা তিনি আমাকে ধরিয়ে দিলেন। বাতি-টাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছি। ভোর আটটা থেকে ক্লাস–সকালে উঠতে হবে। আনিস ভাই এসে দরজায় টোকা দিলেন, এই ঘুমুচ্ছ না-কি?