জাতক জন্মলগ্নে বৃশ্চিক রাশি
তখন উচ্চস্বরে হাসা ছাড়া পথ নেই। হাজার বছর আগে জন্মালে এই জাতক বৃশ্চিক রাশি হত। আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রগুলি যোগ করলে বৃশ্চিকের মত হয়ত দেখাতো। আজ দেখাবে না। নক্ষত্ররা সরে গেছে।
বাংলাদেশে হস্তরেখাবিশারদের মত অনেক এস্ট্রলজারও আছেন। তাদের সমিতি-টমিতি আছে। তাঁরা মহা সম্মেলন করেন। গ্রহ-নক্ষত্র বিচারে দেশের ভবিষ্যৎ কি তা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দেন। পত্রিকাওয়ালারা সেই সব বিবৃতি খুব আগ্রহ করে ছাপেন। বিস্মিত হয়ে ভাবি, কোন যুগে বাস করছি? জাদুটোনার যুগে না চন্দ্র জয়ের যুগে?
এস্ট্রলজারদের মহা সম্মেলনে একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাটি আমি আগেও এক লেখায় উল্লেখ করেছি। আবারো করছি। যে মহা সম্মেলনটির কথা বলছি সেই মহা সম্মেলনে এরশাদ সাহেবের এক মন্ত্রী ছিলেন প্রধান অতিথি। তিনি তাঁর বক্তৃতায়–মহা সম্মেলনের সাফল্য কামনা করলেন। এস্ট্রলজাররা গ্রহ-নক্ষত্র গুণে দেশ ও জাতির জন্যে যে মঙ্গল করে যাচ্ছেন তার ভূয়সি প্রশংসা করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে এস্ট্রলজির একটি বিভাগ খোলা উচিত সেই সম্পর্কেও বললেন। ঘন ঘন হাততালি পড়তে লাগল।
তখন তিনি একটি মোক্ষম কথা বললেন। তিনি বললেন, এস্ট্রলজারদের জন্যে তিনি একটি মানমন্দির স্থাপনের ব্যবস্থা করবেন।
এস্ট্রলজাররা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। এ কি সমস্যায় পড়া গেল! মানমন্দির দিয়ে তাঁরা কি করবেন? কোন্ গ্রহ ভাল কোন্ গ্রহ মন্দ এটা তো মানমন্দির দিয়ে বোঝা যাবে না। মানমন্দির হচ্ছে এস্ট্রানমারদের জন্যে, এস্ট্রো
ফিজিসিস্টদের জন্যে। তাঁদের প্রয়োজন হাজার বছরের পুরানো পুঁথি–এবং একদল বোকা পাঁঠা জনগুষ্ঠী।
ভাল কথা, শৈশবে যে জ্যোতিষী আমার হাত দেখে বলেছিলেন আমি ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারব, তাঁর গণনা কিন্তু এক অর্থে মিলে গেছে। এইসব দিনরাত্রি নামক ধারাবাহিক নাটকে আমি টুনীকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছি। শুধু টুনী না–আমার উপন্যাসের অনেক চরিত্রকেও অকালে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। আমি কি করব? আমার হাতে লেখা।
রাত একটার পর
রাত একটার পর আমি সাধারণত ঘড়ির দিকে তাকাই না। ঘড়ির দিকে তাকালেই এক ধরনের অপরাধবোধে আক্রান্ত হই। ঘুমুতে যাওয়া উচিত–যাচ্ছি না। দুষ্ট ছেলের মত জেগে আছি। একে একে ঘরের সব বাতি নিভে যাচ্ছে। রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে কাজের মেয়েটি ঘুমুতে গেল। চারদিক চুপচাপ। এর আগের রাতও জেগে কাটিয়েছি। আরো কয়েক রাত এমন করে কাটলে পুরোপুরি অনিদ্রায় ধরবে। শরীরের নিজস্ব ঘড়ি যাবে উল্টে। দিনে ঘুমুব, রাতে জেগে থাকব।
গত রাত জেগে কাটিয়েছি বিশেষ কারণে। মন বিক্ষিপ্ত ছিল। তুচ্ছ কারণে মন বিগড়ে গেল। অতি তুচ্ছ বিষয় যা তৎক্ষণাৎ মন থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত ছিল, অথচ ঝাড়তে পারি না। বড় বড় ব্যাপারগুলি সহজেই ঝেড়ে ফেলা যায় কিন্তু তুচ্ছ ব্যাপারগুলি চোরকাঁটার মত। কিছুতেই তাড়ানো যায় না। ঘটনাটা বলি–ছোট্ট একটা ইলেকট্রিক্যাল পার্টস কিনতে গিয়েছি। একটা মাল্টি প্ল্যাগ টিভির পেছনে লাগানো থাকবে। একসঙ্গে এন্টেনা এবং ভিসিআর-এর ইনপুট আসবে। দোকানে ঢোকামাত্র দোকানি আনন্দে হেসে ফেলে বলল, আরে আপনি! কি সৌভাগ্য!
আমি বললাম, আপনি কি আমাকে চেনেন?
দোকানি চোখ কপালে তুলে বলল, আপনাকে চিনব না? আপনার বন্ত্রীহি
আমি যথেষ্টই আনন্দিত হলাম। জিনিসটা কিনলাম। দাম জিজ্ঞেস করলাম। দোকানি বলল, পৃথিবীর সব মানুষের কাছ থেকে লাভ করা যায়, আপনার কাছ থেকে করা যায় না। আপনার সঙ্গে ব্যবসা করলে অধর্ম হয়। আমি যে দামে কিনেছি সেই দাম দিন। একটা পাই পয়সা বেশি রাখব না। একশ চল্লিশ টাকা।
আমি একশ চল্লিশ টাকা দিলাম।
স্যার চা খান।
না, চা খাব না।
আপনি আমার দোকান থেকে চা না খেয়ে যাবেন, তা তো হয় না।
চা এল। আমি চা খেয়ে খুশি মনে রওনা হলাম। মানুষকে অবিশ্বাস করলে ঠকতে হয়। যে সবাইকে বিশ্বাস করে সে কখনো ঠকে না।
আমার কি যে হল–অবিশ্বাসের সামান্য কণা মনে জন্মাল। অন্য একটা দোকানে এই জিনিসটির দাম জানতে চাইলাম। তারা বলল, একশ টাকা। আরো একটা দোকানে গেলাম। তারাও বলল, একশ। আমি হতভম্ব। তখন মনে হল–লোকটাকে অবিশ্বাস করেছি বলে ঠকেছি। অন্য কোথাও দাম জিজ্ঞে: না করলে তো কৈতাম না। চল্লিশ টাকা এমন বড় কিছু নয়।
একবার ভাবলাম, প্রথম দোকানে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করি–ভাই, এই কাজটা আপনি কেন করলেন? সামান্য চল্লিশটা টাকার জন্যে করলেন, নাকি আমাকে বোকা বানানোর জন্যে করলেন?
আমি লোকটির কাছে গেলাম না। প্রচণ্ড রাগ বুকে পুষে ঘরে ফিরে এলাম। রাতে বিছানায় ঘুমুতে গিয়ে মনে হল, ঐ লোক তার স্ত্রীর সঙ্গে নিশ্চয় হাসতে হাসতে গল্প করছে–আজ আমাদের দোকানে এসেছিল এক বোকা লেখক। ব্যাটাকে মাথা মুড়িয়ে ছেড়ে দিয়েছি। হা-হা-হা।
যে মানুষ ঈশ্বরের অংশ তার ভেতর এত ক্ষুদ্রতা কেন? আমি আরো অনেকের মত মানুষকে নিখুঁত প্রাণী হিসেবে ভাবতে ভালবাসি। যদিও খুব ভাল করেই জানি আমার ভেতর অসংখ্য খুঁত আছে। রাগ, লোভ, ঘৃণা, অহংকার সব শুধু যে আছে তাই না–অনেক বেশি পরিমাণে আছে, তবু কেন অন্যের ভেতর এইসব দেখলে এত কষ্ট পাই?