না।
বিড়াল নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর একটা বাচ্চা মুখে নিয়ে টেবিলের উপর লাফিয়ে উঠল। সে যে আমার কথা বুঝে এই কাণ্ড করেছে এটা মনে করার কোনই কারণ নেই। তবু আমার কেন জানি মনে হল বিড়াল বাচ্চাটা মুখে করে এনে লাফিয়ে আমার টেবিলে উঠেছে একটি কারণে। আমার চূড়ান্ত অনুমতি চাচ্ছে।
ম্যাঁও ম্যাঁও। (কি, রাখব আমার সোনামণিদের?]
হ্যাঁ, রাখ।
ম্যাঁয়াও ম্যাঁয়াও [তোমার স্ত্রী আবার আপত্তি করবে না তো?]
না। তাকে আমি বুঝিয়ে বলব।
ম্যাঁয়াও ধন্যবাদ স্যার।]
বিড়াল বাচ্চা নিয়ে কাবার্ডের ভেতর ঢুকে গেল। অন্য বাচ্চাগুলিকেও একে একে নিয়ে এল। আমি তাকে বললাম, একটা শর্ত মনে রাখবে। এরা একটু বড় হলেই তুমি আমার বাসা ছেড়ে চলে যাবে। আমি বিড়াল পছন্দ করি না।
ম্যাঁয়াও (আচ্ছা।)।
ভোরবেলা আমি গুলতেকিনকে ঘটনাটা বললাম। তার ধারণা হল পুরো ব্যাপারটি আমার বানানো। ধারণা করাই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে আমার কথাবার্তার সতুর ভাগই থাকে বানানো। আমি খুব গুছিয়ে সত্যের মত করে মিথ্যা বলতে পারি।
আমি গুলতেকিনকে বললাম, বিড়ালটা কথা দিয়েছে তার বাচ্চাগুলি একটু বড় হলেই সে চলে যাবে।
তোমাকে সে কথা দিয়েছে?
হ্যাঁ। মানুষ কথা দিয়ে কথা রাখে না কিন্তু পশুরা একবার কথা দিলে কথা রাখে।
তুমি তো মনে হচ্ছে অবতারের পর্যায়ে পৌঁছে গেছ। পশুদের ভাষা বুঝতে পার।
তোমার সঙ্গে এক হাজার টাকা বাজি–বাচ্চাগুলি একটু বড় হলেই সে চলে যাবে।
বেশ যাও, হাজার টাকা বাজি।
গুলতেকিন বিড়ালটার জন্য দৈনিক এক পোয়া দুধ বরাদ্দ করে দিল। উচ্ছিষ্ট মাছ মাংস তাকে প্লেটে করে দেয়া হতে লাগল। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। যে রাজকীয় হালে তাকে রাখা হচ্ছে সে তো আর এই বাড়ি ছেড়ে যাবে না। আমাকে বাজিতে হারতে হবে
কিম আশ্চর্যম! বাচ্চা চারটি একটু বড় হতেই বিড়াল এদের নিয়ে চলে গেল।
আমি অবশ্যি বাজির টাকা পেলাম না। কারণ গুলতেকিন তখন যুক্তি দেখাল, তোমাকে কথা দিয়েছে বলে তো আর সে যায় নি। বাচ্চারা বড় হয়েছে–পৃথিবীতে বাস করার ট্রেনিং দেবার জন্যে সে এদের নিয়ে চলে গেছে। তার কথা যে সত্যি তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এর পর মজার ঘটনা ঘটতে লাগল। আশেপাশের যত বিড়াল আছে তারা গর্ভবতী হলেই আমাদের বাসায় চলে আসে। বাচ্চা দেয়। বাচ্চাগুলি একটু বড় হলে এদের নিয়ে চলে যায়। কালো বিড়াল, ধলা বিড়াল, হলুদ বিড়াল। এর মধ্যে একটা ছিল ডাকাতের মত দেখতে।
আমার ধারণা লুসিয়া সমস্ত বিড়াল সমাজের কাছে প্রচার করেছে–হুমায়ূন স্যারের বাসা মেটারনিটি ক্লিনিক হিসেবে অতি উত্তম। এরা যত্ন-আত্তি করে। দুধ খেতে দেয়। শুধু একটা শর্ত, বাচ্চারা বড় হলে বাসা ছেড়ে দিতে হবে।
আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়লাম। একবার তিনটা বিড়াল এক সঙ্গে বাচ্চা দিল। বাচ্চা দিয়েই এরা চুপ করে থাকে না। প্রতিদিন বাচ্চাগুলিকে জায়গা বদল করায়। এই দেখলাম খাটের নিচে, খানিকক্ষণ পরই ট্রংকের কোণায়। ক্ষিধে পেলে এরা গুলতেকিনের শাড়ির আঁচল কামড়ে ধরে টেনে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। নিতান্তই অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
আমি পশু-প্রেমিক নই বলেই একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। দেড় হাজার টাকায় নেট কিনে মিস্ত্রি লাগিয়ে দরজা-জানালা, ফাঁক-ফোকর সব নেট দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে দীর্ঘ ছ বছর পর প্রথম বিড়াল মুক্ত দিবস পালন করলাম।
আমার নিয়ম হচ্ছে গভীর রাতে যখন হলের ছেলেরা বেশির ভাগ ঘুমিয়ে পড়ে তখন গুলতেকিনকে নিয়ে হলের সামনের মাঠে হাঁটাহাঁটি করা। সে রাতেও তাকে নিয়ে বের হয়েছি। চাদনি পহর রাত। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় হাঁটতে অপূর্ব লাগছে। সাধারণত হাঁটাহাঁটির সময় আমি প্রচুর বকবক করি। সে রাতে কেন জানি চুপ করে আছি–গুলতেকিন বলল, তুমি চুপ করে আছ কেন? ঘর নেট দিয়ে বন্ধ করে দেয়ায় তোমার কি মন খারাপ লাগছে?
আমি বললাম, হ্যাঁ, লাগছে।
নেট খুলে দিতে চাও?
না।
না কেন?
আমি শান্ত গলায় বললাম, আমি পশু-প্রেমিক নই গুলতেকিন। সামান্য মন খারাপকে আমি প্রশ্রয় দিতে চাই না।
মন খারাপটা অবশ্য খুব সামান্য ছিল না। সে রাতে কিছুতেই আমার ঘুম এল না।
রাত তিনটা পর্যন্ত চুপচাপ জেগে রইলাম। কিছুতেই ঘুম আসে না। ঘুম এল ফজরের আজানের পর। ঘুম ভাঙল সকাল দশটায়। বিছানা থেকে নেমে দেখি সব নেট খুলে ফেলা হয়েছে। কে খুলল, কার নির্দেশে খুলে ফেলা হল কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না। আমি এবং গুলতেকিন দুজনই এমন ভাব করতে লাগলাম যেন এই প্রসঙ্গ আলোচনার যোগ্য কোন প্রসঙ্গ না। রাতে টিভি দেখছি। আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, আব্বু গেস্ট রুমে আরেকটা বিড়াল এসে বাচ্চা দিয়েছে। এইবারের বাচ্চাগুলি কালো রঙের। কুচকুচে কালো।
আমি মহা বিরক্ত হয়ে বললাম, এ তো বড় যন্ত্রণা হল! এরা পেয়েছেটা কি? অসহ্য। এই বাড়িতে আর থাকা যাবে না। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি গুলতেকিন জানালা দিয়ে মুখ ফিরিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করছে।
———– * আমাদের এই বিড়াল পরিবার নিয়ে আমি বিপদ নামে একটি উপন্যাস লিখেছি। উদ্ভট জাতীয় গল্প যারা ভালবাসেন তারা অন্যের কাছ থেকে বই ধার করে পড়ে দেখতে পারেন।
আত্মকাহিনীমূলক রচনা
আজকালকার ছেলেমেয়েরা আত্মকাহিনীমূলক রচনা শেখে কি-না জানি না তবে আমাদের সময় এ জাতীয় রচনা প্রচুর শিখতে হত। নদীর আত্মকাহিনী, একটি বটগাছের আত্মকাহিনী, চোরের আত্মকাহিনী ইত্যাদি। একের ভেতর তিন নামক একটি গ্রন্থ থেকে আমি বেশ কয়েকটি আত্মকাহিনী মুখস্থ করে ফেলি। এর মধ্যে একটি চোরের আত্মকাহিনীটি খুব করুণ করে লেখা। চোর বলছে, সবাই তাকে মারছে। লোকজন ভিড় করে আছে। সে হঠাৎ শুনল একটি বাচ্চা মেয়ে বলছে, বাবা আমি চোর দেখব। তাকে চোর দেখানো হল। মেয়েটি বলল, আরে এ চোর কোথায়? এ তো মানুষ! এই শুনে চোর আত্মগ্লানিতে জরজর।