বইটিতে লেখা হয়েছে একদল শিশুর কথা, যারা জানে তারা মারা যাচ্ছে। খুব অল্প আয়ু তাদের অবশিষ্ট আছে। এই ভয়াবহ সংবাদটি তারা কি করে আত্মস্থ করে–তাঁরা কি ভাবে তাই নিয়ে লেখা অসাধারণ বই। বইটিতে ন বছর বয়েসী একটি মেয়ের কথা আছে যে তার বাবা-মার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করত। তাঁরা যখনই তাকে দেখতে আসতেন সে চিৎকার, গালাগালি করত। নার্স একদিন বাচ্চাটিকে তার এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ জিজ্ঞেস করল, সে বলল–দেখ, আমি যদি খুব ভাল ব্যবহার করি তাহলে আমার মৃত্যুর পর বাবা-মা অনেক বেশি কষ্ট পাবে। সবাইকে বলবে–আমার মেয়েটা কত ভাল ছিল। বলবে আর কাঁদবে। তাই খারাপ ব্যবহার করছি। যাতে আমার মৃত্যুর পর বাবা-মার কষ্ট কম হয়। এই বই পড়তে পড়তে আমি ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। মৃত্যুর আগের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে আরো ভালভাবে জানার ইচ্ছা হয়েছে। ইচ্ছে হলেও সে সুযোগ কোথায়?
আশ্চর্যের ব্যাপার আমার প্রথম ইচ্ছা শিশুর জন্মদৃশ্য দেখা খুব সুন্দরভাবে পরিপূর্ণ হল। হোটেল গ্রেভার ইন বইটিতে সেই প্রসঙ্গ লিখেছি–আমার দ্বিতীয় কন্যা শীলার জন্মদৃশ্য আমাকে ডাক্তাররাই দেখালেন। আমি স্ত্রীর হাত ধরে তখন পাশেই ছিলাম। অবাক হয়ে শিশুর জন্ম দেখলাম। ডাক্তাররা তার পা উঁচু করে ধরে আছেন। প্রাসেন্টার সঙ্গে শিশুর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এখনো নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া শুরু হয়নি। ডাক্তার শিশুটির পিঠে ছোট্ট করে থাবা দিলেন। সে তৎক্ষণাৎ কাঁদতে শুরু করল। তার ফুসফুস সচল হল–নতুন একটি জগতে সে প্রবেশ করল। কত-না বিস্ময় তার চোখে!
তাকে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে তার মার কোলে শুইয়ে দেয়া হল। কি অবাক কাণ্ড! সে চোখ বড় বড় করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার চোখে পলক পড়ছে না। আমি মনে মনে বললাম, মামণি আমি তোমার বাবা। বিপুল আনন্দের এবং অসাধারণ সৌন্দর্যের এই পৃথিবীতে তুমি এসেছ–আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি–Welcome my little angel.
আমার দ্বিতীয় ইচ্ছাটি পূর্ণ করার ব্যবস্থাও প্রকৃতি করে দিলো। আমার ছেলের মৃত্যু হল আমার চোখের সামনে। মৃত্যুর সময় সেও আমার মেজো মেয়ের মতই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে–। সেই দৃষ্টি সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি ছুটে পালিয়ে এলাম। আবারও ছুটে গেলাম তার পাশে। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ মেলে আমাকে দেখল। আমি আবার পালিয়ে গেলাম।
দুটি দৃশ্য দেখার আমার খুব শখ ছিল। পরম করুণাময় ঈশ্বর (?) আমার দুটি ইচ্ছাই পূর্ণ করলেন।
আশৈশব দুর্বলতা
ঘড়ি নামক বস্তুটির প্রতি আমার আশৈশব দুর্বলতা।
কেউ আবার মনে করে বসবেন না আমি হাই থটের কিছু বলার চেষ্টা করছি–ঘড়ি বহতা সময়ের প্রতীক, মহাকালের প্রহরী ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটেই সে রকম কিছু নয়। আমার দুর্বলতার কারণ ঘড়ি সুন্দর একটা জিনিস। সেকেণ্ডের কাঁটা ক্রমাগত ঘুরছে। তাকিয়ে থাকলে মনে হয় বস্তুটির প্রাণ আছে। কানের কাছে ধরলে হৃদপিণ্ডের শব্দের মত টিকটিক শব্দ হয়।
ক্লাস এইটে প্রথম বৃত্তির টাকা পেয়ে মাকে বললাম, একটা ঘড়ি কিনে দাও।
মা চমকে উঠে বললেন, এই বয়সে ঘড়ি কি রে? আমি তো আমার জন্মে শুনি নি মেট্রিকের আগে কেউ ঘড়ি পরে। না না, এইসব চিন্তা বাদ দে।
লোয়ার কোর্টে মামলা খারিজ হবার পর হাইকোর্টে আপীল করা হয়। আমিও তাই করলাম। এক সন্ধ্যায় বাবার কানে গোপন ইচ্ছার কথা তুললাম। নিজের বলার সাহস নেই। ছোট বোন শেফু আমার হয়ে বলল।
বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন, এই বাচ্চা বয়সে ঘড়ি? বাবুয়ানা শেখা হবে। সব কিছুর একটা সময় আছে। প্রথম দাড়ি-গোঁফ কামাতে হয় মেট্রিক পাসের পর। ঘড়ি কিনতে হয় কলেজে উঠে। আমি প্রথম ঘড়ি কিনি বি.এ. ক্লাসে পড়ার সময়। পাঁচ টাকার কেনা ঘড়ি–এখনো পরছি।
হাইকোর্টে মামলা খারিজ।
আমার ব্যথিত মুখ দেখে হয়ত বাবা খানিকটা নরম হলেন। উদার গলায় বললেন–মেট্রিক পরীক্ষা আসুক, তখন দেখা যাবে।
শেফু বলল, একটা কিনে দিয়ে দিও বাবা। দাদাভাইয়ের খুব বেশি শখ।
আচ্ছা আচ্ছা দেব। হাতে ঘড়ি পরেই পরীক্ষা দিতে যাবি।
দুবছর পার হল। কয়েকবার মনেও করিয়ে দিলাম। বাবা প্রতিবারই হাসিমুখে বললেন, তাঁর মনে আছে। যথাসময়ে পাওয়া যাবে।
বাবার মধ্যে নাটক করার প্রবণতা আছে। আমি নিশ্চিত, প্রথম পরীক্ষা দিতে যাবার সময় বাবাকে সালাম করব, তিনি পকেট থেকে ঝকঝকে ঘড়ি বের করে দেবেন। এবং হাসতে হাসতে বলবেন–কি খুশি?
প্রথমদিন বাংলা পরীক্ষা। বাবাকে সালাম করে উঠে দাঁড়ালাম–তিনি বিব্রত গলায় বললেন, বাবা, তুই আমার হাতঘড়িটা নিয়ে যা। কিছু মনে করিস না। টাকা পয়সার খুব সমস্যা যাচ্ছে, কিনতে পারি নি। কি মন খারাপ না তো?
না
মন খারাপ না হলে মুখ এমন অন্ধকার কেন? এই সংসারে ঘড়ি কি খুব বড় জিনিস? দেব, আমি কিনে দেব। খুব দামী ঘড়ি কিনে দেব।
বাবার পাঁচ টাকা দামের ঘড়ি বুক পকেটে নিয়ে পরীক্ষা দিতে রওনা হলাম। হাতে পরার উপায় নেই। বেল্ট বড়, হাতে ঢলঢল করে।
কলেজ জীবনটাও আমার ঘড়ি ছাড়া কাটল। আমার হোস্টেলের খরচ জোগাতেই বাবা তখন হিমশিম খাচ্ছেন। কিছুতেই সামাল দিতে পারছেন না। ঘড়ি আসবে কোত্থেকে!