উকিল : আপনার দোকানে তো বহু লোক আসা যাওয়া করে। আসামির কথা মনে রেখেছেন কীভাবে? উনি কি প্রায়ই আপনার দোকান থেকে সিগারেট পান বিড়ি এইসব কিনতেন?
নিজাম : জি স্যার।
উকিল : একটা ছোট্ট সমস্যা হলো, আসামি পানও খায় না, সিগারেটও খায়। সে কেন রোজ আপনার দোকান থেকে পান সিগারেট কিনবে?
নিজাম হতাশ চোখে তাকাল। ঢোঁক গিলল।
উকিল : ঐ প্রসঙ্গ থাক। জুতাজোড়ার দিকে তাকান। জুতাজোড়া চেনেন?
নিজাম : জি স্যার, বাচ্চাটার পায়ে ছিল।
উকিল : একটা বাচ্চা কাঁদছে। তাকে আপনি ম্যাঙ্গোবার দিলেন। আপনার তো বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকার কথা। আপনি জুতার দিকে তাকিয়ে ছিলেন কেন?
নিজাম : স্যার জুতার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হয়েছে, এইজন্যে জুতার দিকে তাকিয়েছি।
উকিল : আপনি জবানবন্দিতে বলেছেন আসামি বাচ্চাটা কোলে নিয়ে আপনার দোকানে এসেছে। বাচ্চা কোলে থাকলে তো জুতার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হবে না। ঠিক কি-না বলুন?
নিজাম : জি স্যার, ঠিক।
উকিল : মিথ্যা সাক্ষী দিচ্ছেন কেন?
নিজাম : মিথ্যা না স্যার, সত্যি।
উকিল : আপনাকে আমার আর জিজ্ঞেস করার কিছু নেই, আপনি কাঠগড়া থেকে নেমে যেতে পারেন।
কাঠগড়া থেকে নামতে গিয়ে নিজাম হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
উকিল বললেন, মাননীয় আদালতকে একটা বিষয় জানাতে চাচ্ছি। নিজাম নামের এই লোক পুলিশের সোর্সের একজন। পুলিশের মামলায় সে প্রায়ই সাক্ষ্য দেয়। এর আগে তিনবার সে ছিনতাই মামলার সাক্ষ্য দিয়েছে। প্রতিবারই সে ছিনতাই হতে দেখেছে। কিংবা ছিনতাইকারী তার দোকান থেকে বিড়ি সিগারেট কিনেছে।
নুরুল হক কোর্টের কার্যক্রম শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। আজ বৃষ্টি হচ্ছে। ভালো বৃষ্টি। ইচ্ছা করছে একটা রিকশা নিয়ে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরতে। তা সম্ভব না। তাকে গাড়ি নিয়েই ফিরতে হবে। দুপুরে মেয়ে-জামাইকে নিয়ে খেতে বসেছেন। বাবুর্চি সালাম রান্না করেছে। সজনে ডাটা দিয়ে পাবদা মাছ। পাবদা মাছের সঙ্গে সজনে যায় না, তারপরেও খেতে ভালো হয়েছে। তার মেজাজ এখন বেশ খারাপ, কারণ মেয়ে জামাই মুরাদ কাঁটা চামচ দিয়ে পাবদা মাছ খাচ্ছে।
মুরাদ বলল, আব্বা, আপনার মামলার কথা সালামের কাছ থেকে শুনেছি। ফাঁসি কি হবে?
নুরুল হক বললেন, এখনো তো মামলা শেষ হয় নাই।
মুরাদ বলল, বছরের পর বছর মামলা না চালিয়ে লটারিতে চলে যাওয়া দরকার। সময় বাঁচে।
নুরুল হক বললেন, লটারি মানে?
মুরাদ বলল, একটা কাগজে লেখা থাকবে দোষী। আরেকটায় লেখা থাকবে নির্দোষী। বিসমিল্লাহ বলে আপনি কাগজ তুলবেন। যেটা উঠবে সেটা। দোষী উঠলে ফাঁসি। নির্দোষী উঠলে খালাস।
নুরুল হক বললেন, আমি খাবার টেবিলে কথাবার্তা পছন্দ করি না। নিঃশব্দে খাও।
মুরাদ বলল, খাওয়ার টেবিলে আলাপ আলোচনা হজমের সহায়ক। আমি রিডার্স ডাইজেস্টে পড়েছি। একটা অসাধারণ পত্রিকা। সব ইনফরমেশন আছে।
নুরুল হক আধখাওয়া অবস্থায় টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন। রাতে তার জ্বর উঠল। তিনি জ্বর গায়েই গোসল করে পাকপবিত্র হয়ে ইস্তেখাড়ায় বসলেন। যদি আল্লাহপাক স্বপ্নে কোনো ইশারা দেন। এ ধরনের মামলা চলার সময় তিনি সবারই ইস্তেখাড়া করেন। কোনো লাভ হয় না। ইস্তেখাড়ায় প্রশ্নের উত্তর প্রতীকের মাধ্যমে আসে। প্রতীক থেকে অর্থ উদ্ধার সহজ কর্ম না। বড় বড় আলেম ছাড়া কেউ পারে না।
ইস্তেখাড়ায় স্বপ্নে দেখলেন দুটা দাড়কাক। একজন আরেকজনকে ঠুকরে মাংস ছিঁড়ে নিচ্ছে। কাক দুটি কা কা করছে না। ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। বাকি রাত তিনি জেগে কাটালেন।
তদন্তকারী পুলিশ ইন্সপেক্টর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন। মামলার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দিবেন।
পুলিশ ইন্সপেক্টর : আসামি ছেলেটার বাবা-মার কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে বিশ লক্ষ টাকা চেয়েছিল। ছেলেটার বাবা দশ লক্ষ টাকা জোগাড় করে পাঠান। পুলিশকে এই বিষয়ে তারা কিছুই জানান নি।
আসামি দশ লাখ টাকার ব্রিফকেস রেখে আরো দশ লাখের জন্যে চাপ দেয়। তখন তারা পুলিশকে জানায়। আমরা তখন ফাঁদ পাতি। আসামিকে আরো দশ লাখ টাকা নেবার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে বলি। আসামি আসে। আমরা তাকে গ্রেফতার করি।
আমরা তার মোবাইল সেট জব্দ করি। মোবাইল থেকে যে টেলিফোন করে টাকা চাওয়া হয়েছে তা ফোনের রেকর্ড থেকে নিশ্চিত হই। বাড়ি তল্লাশি করে জুতাজোড়া পাই। এই হলো ঘটনা।
উকিল : এটা যে আসামিরই মোবাইল তার কোনো প্রমাণও নেই। মোবাইল সেটটি নতুন এবং তার সিম কার্ড ফাঁকা।
ইন্সপেক্টর : ফাঁকা বলবেন না। এই সিম কার্ডেই বাচ্চার বাবা-মাকে টাকা চেয়ে টেলিফোন করা হয়েছে।
উকিল; বাচ্চাটির ডেডবডি আপনারা কোথায় খুঁজে পান?
ইন্সপেক্টর : আশুলিয়ায়। একটা বস্তার ভেতর ভরে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল।
উকিল : ডেডবডির সন্ধান কী করে পেলেন? আসামি বলেছে?
ইন্সপেক্টর : না। ডেডবড়ি ভেসে উঠেছিল। স্থানীয় লোকজন পুলিশে খবর দেয়।
উকিল : বাচ্চাটির মৃতদেহের ছবি কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই বিষয়ে জানেন?
ইন্সপেক্টর : জানি।
উকিল : ছবিগুলিতে বাচ্চার দুই পায়েই জুতা ছিল। আমি আদালতে ছবি জমা দিচ্ছি। এখন কথা হলো আসামির ঘরে দুটা জুতা কীভাবে এল?
পুলিশ ইন্সপেক্টর থতমত খেয়ে গেলেন
উকিল : মামনীয় আদালত! এটা একটা দুর্বলভাবে সাজানো মামলা। বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হবার কথা।