ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবের কারণে নুরুল হক গায়ের ওপর চাদর দিয়েছেন। ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ নায়লার কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মফস্বল শহরে ডিসট্রিক্ট জজের বাড়ি বিশাল বাড়ি। মেয়েটা দূরে অন্য কোনো কামরায় কাঁদতে পারে, অথচ কাঁদছে আশেপাশে যাতে তিনি শুনতে পান। গাধি মেয়ে।
নায়লার কান্না শুনতে শুনতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্বপ্ন শুরু হলো। স্বপ্নে তিনি বাড়ির পেছনে বকুল গাছের নিচে চেয়ারে বসা। তার সামনের চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে আলাউদ্দিন বসে আছে। আলাউদ্দিনের হাতে পানের কৌটা। সে একটা পান মুখে দিয়ে পিক ফেলল। পিকের রঙ টকটকে লাল। আলাউদ্দিন তার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, স্যার কি একটা পান খাবেন?
আমি পান খাই না।
মহেশখালির পান। মুখে দেয়া মাত্র মাখনের মতো মিলে যাবে। সামান্য একটু জর্দা দিয়ে খেয়ে দেখেন। ময়মনসিংহের মিকচার জর্দা।
আমার স্ত্রী পান খেতেন। আমি খাই না।
আচ্ছা স্যার, মামলার অবস্থাটা কী বলেন। পুলিশের সাক্ষী প্রমাণ তো খুবই দুর্বল। একজন পানওয়ালা জোগাড় করেছে যে বলছে আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে তার দোকান থেকে ম্যাঙ্গোবার কিনে বাচ্চার হাতে দিয়েছি। পুলিশের জোগাড় করা মিথ্যা সাক্ষী।
নুরুল হক বলেন, মিথ্যা সাক্ষীর ওপরও অনেক সময় ফাঁসি হয়।
আপনার ক্ষেত্রে হবে না। আপনি কঠিন লোক। তবে স্যার পাবলিক প্রসিকিউটর জুতা জোড়া নিয়ে যে যাত্রাপালার পাট গাওয়া শুরু করেছে সেটা বন্ধ করা দরকার। এই বিষয়ে কি আপনি একমত?
হুঁ।
যে কাঁদছে সে আপনার মেয়ে?
হুঁ।
তাদের সন্তানাদি কী?
তাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। অনেক চেষ্টা করেছে, লাভ হয় নি।
টেস্টটিউবে যেতে বলেন।
এইসব নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাচ্ছি না।
আলাউদ্দিন আরেকটি পান মুখে দিতে দিতে বলল, ছেলেপুলে না হওয়ার ভালো দিকও আছে।
ভালো দিক কী?
কেউ তাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলতে পারবে না। মুক্তিপণ চাইতে পারবে না। ঠিক বলেছি না স্যার?
হুঁ।
একটা পান দিই, খেয়ে দেখেন। মৃতা স্ত্রীর কথা মনে করে খাবেন। তার স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখানো হবে। স্যার, পান দেব?
দাও।
স্বপ্নের মধ্যে পান চিবুতে চিবুতে তাঁর ঘুম ভাঙল। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছেন। ঘর অন্ধকার, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।
নায়লা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালাল। নরম গলায় বলল, বাবা চা দেব?
চায়ের সঙ্গে এক পিস কেক খাবে? ফুট কেক। আমি বানিয়েছি।
না, শুধু চা।
নায়লা চা আনতে গেল। তিনি স্ত্রীর ছবির দিকে তাকালেন। ছবির পাশে কেনেডি সাহেবের ছবি নেই। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
নায়লা চা এনে বাবার পাশে বসল। আদুরে গলায় বলল, তুমি হুটহাট করে এমন রাগ কর কেন বাবা?
নুরুল হক বললেন, বয়স হয়েছে, মনে হয় এইজন্যে।
নায়লা বলল, বাবা, আমি তোমার সঙ্গে নয়মাস থাকব।
নুরুল হক বললেন, থাকতে চাইলে থাকবি। সমস্যা কী?
তোমার জামাইও থাকবে। সে আমাকে ছাড়া একঘণ্টাও থাকতে পারে না, এইজন্যে থাকবে। আমি বললাম, তোমার গ্রোসারি শপের কী হবে? সে বলল, গোল্লায় যাক গ্রোসারি শপ। তুমি যেখানে আমি সেখানে।
নুরুল হক কিছু বললেন না, চায়ে চুমুক দিলেন। চা-টা খেতে ভালো হয়েছে। নায়লা বলল, বাবা! নয়মাস কেন তোমার এখানে থাকব বুঝতে পেরেছ?
বাবার সঙ্গে থাকবি, এর মধ্যে বুঝাবুঝির কী আছে?
নায়লা বলল, আমার বাচ্চা হবে। এখন দুইমাস। আমেরিকান ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেছেন। বাবা, তুমি আমাদের দুজনকে গাধা বলে, তোমারও কিন্তু বুদ্ধি কম।
এতদিন বাচ্চা হবার খবরটা বলিস নাই কেন?
লজ্জা লাগছিল বাবা।
নুরুল হক বললেন, আয় আমার কোলে মাথা রেখে কিছুক্ষণ শুয়ে থাক।
নায়লা বাবার কোমর জড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে কোলে মাথা রেখে শুয়ে ফোপাতে লাগল।
নুরুল হক বললেন, তোর জামাই কোথায়?
নায়লা বলল, আশেপাশেই আছে। তোমাকে খুব ভয় পায় তো, এইজন্যে দূরে দূরে থাকে।
কোর্ট শুরু হয়েছে।
আলাউদ্দিন আজ হালকা নীল রঙের হাফশার্ট পরেছে। তাকে সুন্দর লাগছে। নুরুল হক পাবলিক প্রসিকিউটরের হাত থেকে জুতাজোড়া চেয়ে। নিলেন। দেড় দুবছর বয়সি ছেলের রঙিন জুতা। চাপ দিলেই বাজনা বাজে। জুতার একপাশ থেকে আলো বের হয়। সুন্দর সুন্দর জিনিস বের হচ্ছে। এরকম এক জোড়া জুতা তাকে তার নাতি বা নাতনির জন্যেও কিনতে হবে। জুতা পায়ে সে ঘুরবে, ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে বাজনা বাজবে। বাচ্চার মা নিশ্চিত থাকবে, বাচ্চা জুতা পায়ে কোথায় যাচ্ছে শব্দ শুনে বুঝে যাবে। নুরুল হক বেশ কয়েকবার জুতা টিপে আওয়াজ করলেন।
শব্দটা শুনতে ভালো লাগছে। একজন জজ সাহেব জটিল খুনের মামলায় জুতা নিয়ে খেলতে পারেন না। তিনি কাঠগড়ার দিকে তাকালেন। কাঠগড়ায় আছে নিজাম। পান-বিড়ি দোকানের মালিক। তাকে ভীত এবং চিন্তিত লাগছে। মনে হয় সে জীবনের প্রথম কাঠগড়ায় উঠেছে। হতাশ চোখে চারদিক দেখছে। তার কপালভর্তি ঘাম। একটু পর পর সে অতি নোংরা রুমাল দিয়ে কপাল মুছলো। উকিল প্রশ্ন শুরু করলেন। আসামি পক্ষের উকিল। সাত্তার নাম। অতি ধুরন্ধর। হামিদের মতো গর্ধব শ্রেণীর না।
উকিল : আপনার নাম?
নিজাম : জনাব, আমার নাম নিজাম।
উকিল : আপনার একটা পানের দোকান আছে?
নিজাম : জি।
উকিল : আপনি আসামিকে চিনেন?
নিজাম : জি। উনি আমার দোকান থেকে একটা ম্যাঙ্গোবার কিনে বাচ্চাটাকে দিয়েছেন।