জজ হিসাবে তার ভূমিকা রাখা উচিত। হিন্দি সিরিয়ালে দেখা যায়, জজদের হাতে কাঠের হাতুড়ি থাকে। তারা হাতুড়ি দিয়ে হাসির শব্দ বা হৈচৈ থামান। বাস্তবে হাতুড়ি বলে কিছু থাকে না। থাকলে ভালো হতো। টেবিলে বাড়ি দিয়ে বলতে পারতেন, order! order!
নুরুল হক শব্দ করে গলা খাঁকারি দিলেন। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা গেল বুক পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে গেল এবং হাসির শব্দ থেমে গেল। আসামি এবং পাবলিক প্রসিকিউটর দুজনই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। আসামিকে যথেষ্ট বুদ্ধিমান বলে মনে হচ্ছে। হামিদকে দেখাচ্ছে দাড়িবিহীন ছাগলের মতো।
নুরুল হক বললেন, কোর্টের কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চলা বাঞ্ছনীয়। আসামিকে নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে যথাযথভাবে প্রশ্নের জবাব দেবার জন্যে।
হামিদের মুখে হাসি দেখা গেল। এই হাসির নাম আকৰ্ণ বিস্তৃত হাসি। তার সবকটা পান খাওয়া লাল দাঁত দেখা যাচ্ছে। নুরুল হক যথেষ্টই বিরক্ত হলেন। দাতের বিষয়ে তাঁর শুচিবায়ু আছে। প্রতিবার খাওয়ার পরে তিনি দাঁত ব্রাস করেন। তার ধারণা একজন মানুষের স্বভাব-চরিত্রের বড় পরিচয় তার দাঁত। আসামির দাঁতগুলি একবার দেখতে পারলে হতো। তবে তিনি তো আর আসামিকে বলতে পারেন না–দেখি, দাঁত দেখি।
পাবলিক প্রসিকিউটর : আপনার নাম?
আসামি : আলাউদ্দিন।
পাবলিক প্রসিকিউটর; আপনার পিতার নাম?
আসামি : আমার বাবার নাম আমি বলব না। কারণ আমি আসামি, আমার বাবা আসামি না।
পাবলিক প্রসিকিউটর : আপনার বাবার নাম বলুন।
আসামি : ডঃ আব্দুল হাই। Ph.D
পাবলিক প্রসিকিউটার; আপনার বাবার নাম নাসিমুদ্দিন। তাহলে কেন বললেন ডঃ আব্দুল হাই Ph.D?
আসামি : আপনি আমার বাবার নাম জানেন কি-না, তা জানার জন্যে করেছি। এখন দেখা যাচ্ছে আপনি জানেন। খামাকা বিরক্ত করছেন।
কোর্টরুমে আবারো হাসির শব্দ উঠল। এবারের হাসির শব্দ আগের চেয়েও জোরালো। নুরুল হক বিরক্ত মুখে ইশারায় হামিদকে কাছে ডাকলেন। হামিদ গলা নামিয়ে বলল, বদের বাচ্চার অবস্থাটা দেখেছেন স্যার। ঠাট্টা ফাজলামি করছে।
নুরুল হকের নাকে ভক করে জর্দার কড়া গন্ধ লাগল। তিনি বললেন, আপনি কোর্ট রুমে পান জর্দা এইসব খান নাকি?
না তো স্যার।
আগুমেন্টে আসার আগে দেখলাম টিনের কৌটা খুলে পান মুখে দিলেন।
নো, নেভার।
নুরুল হকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি মিথ্যা সহ্য করতে পারেন না। অথচ তার কাজই এমন যে বাস করতে হয় মিথ্যার মধ্যে। নুরুল হক বললেন, নাম কী তা দিয়ে তো আপনি সারা দুপুর নষ্ট করছেন। মূলে চলে আসুন।
হামিদ বললেন, নাম তো স্যার মূলের মূল।
আপনি এক সপ্তাহ কাটিয়ে দেবেন নাম জানার জন্যে? আপনি কোর্টের সময় নষ্ট করছেন।
স্যার, আসামিকে খেলায়ে ডাঙায় তুলতে হলে শুরু থেকে ধরতে হয়।
আসামি মাছ না যে তাকে খেলায়ে ডাঙায় তুলতে হবে। আর আপনিও মাছ শিকারি না।
হামিদ চোখ-মুখ শক্ত করে বললেন, স্যার, আমার বিষয়ে কি আপনার অনাস্থা আছে? আপনি কি মনে করেন যে আমি কম্পিটেন্ট না?
নুরুল হক বললেন, আমি কিছুই মনে করছি না। ঠিক আছে যান। যা ইচ্ছা করুন।
হামিদ এমনভাবে যাচ্ছে যেন যুদ্ধ জয় করে শিবিরে ফিরে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসিও আছে। সবই হিন্দি সিরিয়ালের কোর্ট সিন থেকে শেখা। হিন্দি সিরিয়ালগুলি অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস শেখাচ্ছে। তিনি নিজেও কিছু কিছু শিখছেন। যেমন একটা শায়ের শিখলেন–
দানে দানে পর লিখ্যা হায়
খানেওয়ালাকা নাম
গুল্লি গুল্লিপর লিখ্যা হয়
মরনেওয়ালেকা নাম।
এর অর্থ, খাবারের প্রতিটি দানায় লেখা আছে যে খাবার খাবে তার নাম। একইভাবে প্রতিটি গুলিতে লেখা আছে যে মারা যাবে তার নাম।
নুরুল হকের বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল চুলকাচ্ছে। বুড়ো আঙুল চুলকানোর রোগটা তার নতুন হয়েছে। চুলকানি শুরু হয় ঘুম ভাঙার পর পর। ঘন্টাখানিক চলে। আবার দুপুরের দিকে শুরু হয়। ফরাসি একটা প্রবচন আছে—পঞ্চাশ বছর পার হবার পর ভোরবেলা শারীরিক কোনো যন্ত্রণা ছাড়া যদি ঘুম ভাঙে, তাহলে বুঝতে হবে তুমি মারা গেছ। তাঁর বয়স তিপ্পান্ন। ভোরবেলা কোনো একটা যন্ত্রণা নিয়ে ঘুম ভাঙবে এটাই স্বাভাবিক।
কোর্টে নতুন করে আগুমেন্ট শুরু হয়েছে। হামিদ ছাগলাটা লাল একজোড়া জুতা নিয়ে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করছে। বিরাট অভিনেতা। নুরুল হক তার অভিনয়ে নজর দিতে পারছেন না। তিনি চেষ্টা করছেন ফরাসি প্রবচন কোথায় শুনেছেন সেটা মনে করার। আজকাল স্মৃতিশক্তির সমস্যা হচ্ছে। কিছু মনে থাকছে না। সামুদ্রিক মাছের তেল খেলে না-কি স্মৃতিশক্তি বাড়ে। ভিটামিন ওমেগা নামের কী যেন সামুদ্রিক তেলে আছে। প্রবচন নিয়ে চিন্তা না করে অন্যকিছুতে মন দিলে ঝট করে মনে পড়তে পারে। নুরুল হক উকিল কথাবার্তা কী বলছে শোনার চেষ্টা করলেন–
পাবলিক প্রসিকিউটর; এই জুতা জোড়া কি আপনার ঘরে পাওয়া গিয়েছিল?
আসামি; পুলিশ বলছে পাওয়া গেছে। যখন পাওয়া গেছে তখন আমি ঘরে ছিলাম না।
পাবলিক প্রসিকিউটর : বলতে চাচ্ছেন পুলিশ মিথ্যা বলছে?
আসামি : পুলিশ মিথ্যা বলবে এটাই স্বাভাবিক না? যে বাচ্চাটিকে আমি খুন করেছি বলে বলা হচ্ছে তার জুতী আমি ঘরে কেন সাজিয়ে রাখব? আপনি বোকা হতে পারেন। আমি তো বোকা না।
বোকা শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে নুরুল হকের মনে পড়ল এই প্রবচনটা তিনি শুনেছেন এক বোকার কাছে। বোকাটা তার স্ত্রীকে নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে এসে বর্তমানে তাঁর বাড়িতে আছে। বোকাটা তার একমাত্র মেয়ের জামাই। নাম সুজন। ছেলেটা যে এত বোকা আগে বুঝতে পারেন নি। যতই দিন যাচ্ছে তার বোকামি ততই matured হচ্ছে। সে একটা ভিজিটিং কার্ড বানিয়েছে, সেখানে নিজের নাম সুজন লিখেছেন এইভাবে–