তিন মাস পার হবার পর এক সোমবারে সাইকিয়াট্রিস্ট আমাকে টেলিফোন করলেন।
আমি বললাম, স্যার, মেয়েটি কেমন আছে?
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, ভালো আছে। সে কথা খুব কম বলে এটাই সমস্যা, আর কোনো সমস্যা নেই।
তার মা-বাবার নাম এইসব কি বলেছে?
না। মনে হচ্ছে তার জীবনের শুরু হয়েছে তোমার টেক্সি ক্যাবে ওঠার পর। বড় ধরনের অ্যামনেশিয়া। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো কেটে যাবে।
আমি মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে পারি?
পার। সে চকলেট খুব পছন্দ করে। এক প্যাকেট চকলেট নিয়ে যেতে পার।
স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ।
তোমার সঙ্গে মেয়েটির কী কথা হয় সবই কিন্তু রিপোর্ট করবে।
আনোভা আমাকে দেখে যে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তা-না। সামান্য হাসল। চকলেটের প্যাকেট হাতে নিল। মাথা নিচু করে বলল, থ্যাংক য়্যু।
আমি এক ঘণ্টা সেই বাড়িতে ছিলাম। আনোভার ফোস্টার মাদার আমাকে কফি খাওয়ালেন। নানান গল্প করলেন। সবই রাজনৈতিক। তিনি ডেমোক্রেট দলের একজন। তার গল্পের সবটাই রিপাবলিকানদের বদনাম।
যতক্ষণ আমি থাকলাম, ততক্ষণই আনোভা আমার পিঠে হেলান দিয়ে বসে রইল। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। শরীরের স্পর্শ পাচ্ছি।
একসময় ঘরে শুধু আমি আর আনোভা। বাড়িওয়ালি লনে ঘাস কাটতে গিয়েছে। ঘাস কাটা মেশিনের শব্দ হচ্ছে। আমি বললাম, আনোভা, যাই?
আনোভা পেছন থেকে একটা হাত এনে আমার সামনে ধরল। সেখানে একশ ডলারের একটা নোট। আনোভা স্পষ্ট গলায় বলল, মা তোমাকে এই ভলীরটা দিতে বলেছিল। তুমি নাও। না নিলে She will be sad.
আমি ডলার নিতে নিতে বললাম, তুমি কি তোমার মার বিষয়ে আর কিছু আমাকে বলবে?
আনোভা বলল, No.
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমার খুবই জানতে ইচ্ছা করে।
আনোভা আমাকে অবাক করে দিয়ে ফিসফিস করে পরিষ্কার গলায় বলল, আমার মার সঙ্গে তোমার আরো একবার দেখা হবে।
কোথায়? কখন?
আনোভা জবাব দিল না।
স্যার, মেয়েটার সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা। সাইকিয়াট্রিস্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করল। আমি চলে আসার পর মেয়েটি না-কি খুব কেঁদেছে। কাজেই আমি তার ওপর মেন্টাল ট্রেস তৈরি করেছি। Trauma না কী যেন হয়েছে। হারামজাদা দেশ তো স্যরি। হারামজাদা দেশের হারামজাদা নিয়মকানুন। Mother Fuck Country.
স্যার, সরি। বেশি রেগে গিয়েছি। কী বলতে কী বলছি। বেয়াদবি নিজগুণে মাফ করবেন।
মেয়েটার জন্যে তারা নতুন Foster Family বের করে। তার ঠিকানা আমি জানি না। একবার শুনেছি স্কুলে সে খুব ভালো করছে। তাকে সাধারণ স্কুল থেকে সরিয়ে Gifted Children-এর স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনার পর দশ বছর কেটে গেছে। আমি আমার মতো আছি। ক্যাব চালাই। ব্যাংকে টাকা জমাই। ডিসেম্বর মাসের ২৭ তারিখে ঘোরাঘুরি করি ঐ রাস্তায়, যেখানে প্রথম আনোভা এবং তার মার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। যদি সেই মহিলার সঙ্গে দেখা হয়। দেখা হয় নি।
আনোভার দেয়া একশ ডলারের নোটটা এখনো আমার কাছে আছে। স্যার, নোটটা কি দেখবেন?
আলাউদ্দিনের ফাঁসি
ডিসট্রিক্ট দায়রা জজ নুরুল হক সাহেবের বুকে অনেকক্ষণ হলো কফ জমেছে। কফ সবার জন্যে হালকাভাবে খুকখুক করেছেন। তাতে লাভ হচ্ছে না। তাকে শব্দ করে কাশতে হবে। তিনি কিছুটা ব্ৰিত বোধ করছেন। আদালতে বিচার চলছে। রাষ্ট্র বনাম আলাউদ্দিন মামলা। আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে শিশু হত্যার অভিযোগ। আলাউদ্দিনকে এই মুহূর্তে পাবলিক প্রসিকিউটর প্রশ্ন করছেন। সবার দৃষ্টি সেই দিকে। এখন তিনি যদি বিকট শব্দে কাশেন সবাই তার দিকে তাকাবে। এটা একটা বিব্রতকর ব্যাপার হবে। নুরুল হক আসামির দিকে তাকালেন। এবং দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। একজন বিচারক হা করে আসামির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেন না। বিশেষ করে সেই আসামি যাকে ফাঁসির হুকুম তিনিই দেবেন। তবে এখনো মনস্থির করেন নি। নুরুল হক সওয়াল-জবাবের দিকে মন দিলেন।
পাবলিক প্রসিকিউটর হামিদ প্রশ্ন করছে। প্রশ্নের মধ্যে নানান নাটকীয়তা। গলার উঠা-নামা। হাত-পা নাড়ানো। নুরুল হকের মনে হলো, হামিদ হিন্দি সিরিয়াল দেখে দেখে এইসব শিখেছে।
পাবলিক প্রসিকিউটর : আপনার নাম?
আলাউদ্দিন; জনাব, আমি আমার নাম অনেকবার আপনাকে বলেছি। গতকালও বলেছি। এক রাতের মধ্যে তো আমি আকিকা করে নাম বদলাতে পারি না।
পাবলিক প্রসিকিউটর : আপনাকে যা জিজ্ঞেস করা হবে আপনি জবাব দেবেন। আপনার নাম?
আলাউদ্দিন : নাম ভুলে গেছি। আপনি সুন্দর দেখে একটা নাম দিয়ে দেন। কোর্টের খরুচে খাসি জবেহ করে আকিকা করেন।
পাবলিক প্রসিকিউটর : আপনাকে যা প্রশ্ন করা হবে তার জবাব দিতে হবে। আপনার নাম কী?
আলাউদ্দিন : নাম বলব না।
পাবলিক প্রসিকিউটর; বলতেই হবে।
আলাউদ্দিন : বলেছি তো বলব না। আপনি এক কাজ করেন, আমাকে শাস্তি দেন। নাইলনের দড়ি দিয়ে কোর্টের মধ্যেই নিজের হাতে সিলিং ফ্যানে ঝুলায়ে দেন।
আলাউদ্দিন সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে কল্পনায় সিলিং ফ্যানে ঝুলে থাকার দৃশ্য দেখছে। কোর্ট রুমে জোরালো হাসির শব্দ হলো। নুরুল হক এই ফাঁকে কেশে বুকের কফ পরিষ্কার করে নিলেন। এখন তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন। তবে পাবলিক প্রসিকিউটরের ওপর যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। নাম কী নাম কী বলে লেবু কচলায়ে বিষ বানায়ে ফেলেছে। সারাদিন চলে যাবে নাম জানতে। আসামির মুখ থেকে নাম যেন জানতেই হবে। আসামিও ঔদড় আছে। নাম বলবে না। তার নিজেরই একবার ইচ্ছা করছিল বল–আসামির নাম আলাউদ্দিন। তার বাবার নাম নাসিমুদ্দিন।