ভয়াবহ দুর্যোগের রাতে এই মেয়েটা এখানে কেন? অনেক সময় হুকাররা এরকম দাঁড়ায়। লিফট চায়। পরে নানান ঝামেলা করে। খুনখারাবি পর্যন্ত হয়। স্যার, হুকার বুঝেছেন তো? ঐ দেশে বেশ্যা মেয়েদের বলে হুকার।
এই মেয়েটি হুকার না। তার সঙ্গে বাচ্চা একটা মেয়ে আছে। সম্ভবত তার মেয়ে। তুষারঝড়ে বিপর্যস্ত। আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। ঘটে যাবে। আমি গাড়ি থামালাম। দরজা খুলে দিলাম। তরুণী বাচ্চা একটা মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। অতি বিনয়ের সঙ্গে বলল, Sir thank you.
কালো ক্যাব ড্রাইভারকে কেউ স্যার ডাকে না। আমি তরুণীর দ্রতায় মুগ্ধ হলাম। মেয়েটি অতি রূপবতী। কোনো আমেরিকান মেয়েকে আমার কাছে রূপবতী লাগে না। মনে হয় ধবল কুষ্ঠের রোগী। এই মেয়েটির চুল সোনালি। দেখতে ছবির মতো। তার বাচ্চাটার চুলও সোনালি। বাচ্চাটা ঠান্ডায় কাহিল হয়ে আছে। সে মনে হয় ক্ষুধার্ত। ফিসফিস করে মাকে কী যেন বলল। তার মা লজ্জিত গলায় বলল, আমার মেয়েটা বার্গার খেতে চায়। তোমার পক্ষে কি সম্ভব হবে সামনের কোনো সার্ভিস স্টেশনে গাড়ি থামানো?
আমি বললাম, অবশ্যই সম্ভব।
আমার মেয়ের নাম আলোভা। ওর কাছে ফুড় কেনার মতো ডলার আছে।
স্যার কি বুঝতে পারছেন যে কথাবার্তা সব ইংরেজিতে হচ্ছে। আমি আপনাকে বলছি বাংলায়। কারণ হুবহু কথাগুলি মনে নাই।
অনেক ঝামেলা করে সার্ভিস স্টেশনে পৌছলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি আনোভা চুপচাপ বসে আছে। তার হাতে একশ ডলারের একটা নোট
আনোভার মা নেই। সে যাবে কোথায়? একটা মানুষ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। দরজা। খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে সে নেমে পড়েছে তাও হবে না। গাড়ির দরজা লক করা।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, তোমার মা কোথায়?
আনোভা বলল, Gone.
আমি বললাম, Gone মানে? কোথায় গন?
আনোভা কোনো জবাব দিল না। প্রশ্ন করলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর চোখ নামিয়ে নেয়।
মেয়েটাকে বার্গার কিনে দিলাম। আইসক্রিম কিনে দিলাম। সে আগ্রহ করে বার্গার খাচ্ছে। তার মা হাওয়া হয়ে গেছে, এতে তাকে কোনোরকম চিন্তিত মনে হলো না।
সার্ভিস স্টেশন থেকেই আমি পুলিশকে টেলিফোন করে ঘটনা জানালাম। তবে মেয়েটার মা যে গাড়িতেই হাওয়া হয়ে গেছে এই তথ্য গোপন করলাম। এই কথা বললে পুলিশ আমাকে মানসিক রোগী ভাববে। আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হবে। ক্যাব ড্রাইভিং-এর লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে।
আমি বললাম, মা-মেয়েকে গাড়িতে তুলে একটা সার্ভিস স্টেশনে নিয়ে এসেছি। মেয়েটাকে রেস্টুরেন্টে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করছি–দেখি মেয়ের মা আসছে না। তার খোঁজে গাড়ির কাছে গিয়ে দেখি সে নেই।
মেয়েটা কত বড়?
পাঁচ-ছয় বছর হবে।
তাকে টেলিফোন দাও। আমি তার সঙ্গে কথা বলি।
ওপাশ থেকে পুলিশ কী বলল আমি শুনতে পাচ্ছি না। মেয়েটা কী বলছে শুনছি। প্রথম বলল, আনোভা।
তারপর বলল, ফোর এন্ড হাফ। মনে হয় বয়স বলল। তারপর বলল, Gone, তারপর শুধু No, কয়েকবার No বলার পর বলল, Ok.
সে টেলিফোন আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। পুলিশ আমার লাইসেন্স নাম্বার, ঠিকানা, সব হাবিজাবি নিয়ে বলল, তুমি নিউইয়র্কে মেয়েটাকে নিয়ে চলে এসো। সরাসরি আমাদের কাছে আসবে। পুলিশের একটা পেট্রোল কার আধাঘণ্টার মধ্যে সার্ভিস স্টেশনে পৌছে যাবে। সেই কার তোমাকে ফলো করবে। পেট্রোল কার না আসা পর্যন্ত তুমি মুভ করবে না।
স্যার, কী যে দুশ্চিন্তায় পড়লাম কলার না। আমার ধারণা হলো, পুলিশ আমাকে সন্দেহ করছে। হয়তো ভাববে মেয়েটার মাকে আমি খুন করে বরফের গাদায় ডেডবডি লুকিয়ে রেখেছি। ঐ দেশের পুলিশ যে কত খারাপ আপনি চিন্তাই করতে পারবেন না।
যাই হোক, পুলিশের গাড়ি মেয়েটাকে নিয়ে চলল। আমি যাচ্ছি পেছনে পেছনে। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ছি।
প্রিসিংটে, স্যার ওদের দেশের থানাকে বলে প্রিসিংট, আমাকে ছয় ঘণ্টা আটকে রাখল। মেয়েকে প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদ করল।
তোমার বাবার নাম কী?
মার নাম কী?
কোথায় থাক?
কোন স্কুলে পড়?
প্রিয় বান্ধবীর নাম কী?
তোমার কি কোনো পেট আছে?
আনোভা কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিল না! কঠিন মেয়ে। ছয় ঘণ্টা পর আমি ছাড়া পেলাম। মেয়েটাকে তারা রেখে দিল।
বাসায় ফিরে আমি দশ রাকাত নফল নামাজ পড়লাম বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার কারণে। যদিও জানি উদ্ধার এখনো পাই নি। যে-কোনো সময় পুলিশের। কাছ থেকে ডাক আসবে।
কুড়ি দিনের দিন ডাক পড়ল। গেলাম। পুলিশ অফিসার বললেন, আনোভার কোনো ট্রেস তারা বের করতে পারে নি। চেষ্টা পুরোদমে চলছে।
স্যার কি জানেন আমেরিকার মতো সভ্য দেশে হাজার হাজার শিশু প্রতিবছর হারিয়ে যায়? পুলিশ তার কোনো হদিস বের করতে পারে না।
আমি বললাম, স্যার মেয়েটা কোথায়? মেয়েটাকে একজন Foster Parent-এর কাছে দেয়া হয়েছে। আমি কি তার সঙ্গে দেখা করতে পারি?
সাইকিয়াট্রিস্ট অনুমতি দিলে দেখা করতে পারবে। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট মেয়েটিকে পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।
আমি কি যেতে পারি?
পার। তুমি মেয়েটিকে দেখতে চাচ্ছ তা সাইকিয়াট্রিস্টকে জানানো হবে। সাইকিয়াট্রিস্টই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তার নাম পূল।
তিন মাস পার হয়ে গেল। কেউ যোগাযোেগ করল না। ধরেই নিলাম সাইকিয়াট্রিস্ট চান না আমি দেখা করি। আমেরিকা হচ্ছে স্যার মাথা খারাপের দেশ। সবচে বড় মাথা খারাপ সাইকিয়াট্রিস্ট হারামজাদাগুলার। খারাপ গালি ব্যবহার করেছি স্যার, কিছু মনে করবেন না।