সগিরনের চোখে পানি এসে গেছে। সে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল। জয়নাল বলল, তুমি তো বাচ্চাটারে চউখ লাগায়া দিবা। বেশি স্নেহ পড়লেই চউখ লাগে। অজু কইরা দুই রাকাত নফল নামাজ পইড়া আল্লাপাকরে বলল যেন চউখ না লাগে।
সগিরন নামাজ পড়তে উঠে গেল।
টুলটুলদের বাড়িতে সগিরনের কাজের পনেরো দিনের মতো হয়েছে। এই পনেরো দিনে টুলটুল সগিরনকে ভালোমতো চিনেছে। সগিরন যদি ডাকে, বাবু কই গো!
টুলটুল সঙ্গে সঙ্গে বলে সর্গি। সগি মানে সগিরন। বলেই সে দুহাত বাড়িয়ে বলে কুলা। কুলার অর্থ টুলটুল কোলে উঠতে চাচ্ছে। তাকে কোলে নেয়াতে বিপদ আছে। সে কথা নেই বার্তা নেই কুট করে সগিরনের ঘাড়ে কামড় দিবে। সগিরন ব্যথা পেলেও কিছু বলে না। বেচারার দাঁত শিরশির করে। না কামড়িয়ে কী করবে!
সগিরন প্রতিদিনই নতুন নতুন গল্প স্বামীর জন্যে নিয়ে আসে। সেইসব গল্প শুনতে জয়নালের বড় ভালো লাগে। টুলটুলকে দেখতে ইচ্ছা করে। সগিরনের পক্ষে সম্ভব না বাচ্চাটাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসে। তার পক্ষেও সেই বাড়িতে যাওয়া সম্ভব না। এক্সিডেন্টে তার বাম পা কাটা পড়ায় সে ঘরেই বন্দি। ক্র্যাচ একটা আছে। বগলে ক্র্যাচ লাগিয়ে হাঁটতে বের হওয়া তার কাছে ঘৃণাকর। যে একদিন বাতাসের আগে রিকশা চালিয়েছে, সে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটবে ছিঃ ছিঃ।
রাতে ভাত খেতে বসে সগিরন বলল, আইজ কী হইছে শুনেন। বাবুর পিতামাতার মধ্যে বাজি। বাবু পিতামাতার মধ্যে কারে বেশি পছন্দ করে। বাপ মা দুইজন ঘরের দুই কোনায় দুই সোফায় বসছে। আমি বাবুরে কুলে নিয়া মধ্যিখানে খাড়ায়া আছি। আমি বাবুরে ছাইড়া দিব। বাপ-মা দুইজনেই একত্রে ডাকব, আয় আয়। বাবু কার দিকে যায় সেই বাজি।
জয়নাল বলল, পুত্রসন্তান তো মার কোলে ঝাঁপ দিয়া পড়বে। এইটাই জগতের নিয়ম।
সগিরন বলল, শুনেন না ঘটনা কী। আমি বাবুরে ছাড়লাম। দুইজনেই একত্রে হাত উঠায়া ডাকতেছে, আয় আয়। বাবু রওনা হইল বাপের দিকে। মায়ের মুখটা কালো হইয়া গেল। বাপের কাছাকাছি গিয়া বাৰু তার বাপের দিকে তাকায়ে হাসল, তারপরেই এক দৌড়ে মার কোলে ঝাপ দিয়া পড়ল।
জয়নাল তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, বলছিলাম না মার কোলে যাবে! কথায় আছে–কিসের মাসি, কিসের পিসি কিসের বৃন্দাবন। মরা গাছে ফুল ফুটেছে, মা বড় ধন। বাজিতে হাইরা টুলটুলের পিতা কী বলল?
বলল, নটি বয়।
নটি বয় কী?
আহ্লাদের একটা কথা। স্যারের মনে আহ্লাদ হইলেই স্যার বলেন, নটি বয়।
জয়নাল বলল, বাজি কী ছিল? টাকাপয়সার বাজি?
সগিরন বলল, না। চোখের ইশারায় বাজি হইছে, তয় আমি অনুমান করেছি।
কী অনুমান করছ?
সেটা বলব না, লজ্জার বিষয় আছে।
থাক তাইলে, বলার প্রয়োজন নাই। বাবুর একটা ছবি যদি সম্ভব হয় আনবা। দেখতে ইচ্ছা করে। পরে ফিরত দিও।
আইচ্ছা চেষ্টা নিব।
দুইদিনের ভেতর সগিরন ছবি নিয়ে এল। আনন্দে সে ঝলমল করছে, কারণ এই ছবি তাকে ফেরত দিতে হবে না। সগিরন বলল, বাবুর মা যে কী ভালো এটা আপনের কল্পনার মধ্যেও নাই। আমি যখন বাবুর একটা ছবি চাইলাম আপা বলল, ছবি দিয়ে কী করবে?
আমি বললাম, আমার স্বামীর তারে খুব দেখার ইচ্ছা। উনারে দেখায়া ছবি ফিরত দিব।
আপা বললেন, এই নাও ছবি, ফিরত দিতে হবে না।
জয়নাল বলল, এইটাই হইল উচ্চ শিক্ষার গুণ। বুঝছ? তারার শিক্ষা যদি না থাকত তাইলে ছবি দিত না।
সগিরন বলল, অতি সত্য কথা। আপার আরেকটা ঘটনা শুনেন। বাবু করছে কী, তার বাপের সিগারেটের ছাইদানি থাইকা একটা আধখাওয়া সিগারেট নিয়া চাইতে শুরু করেছে। আমি যতই বলি, বাবা ফেলো। বাবা ফেলো। বাবু ততই চাবায়। মুখে আঙুল দিয়া বাইর করতে গেছি, বাবু তখন গিল্লা ফেলল।
জয়নাল বলল, এত বড় একটা ঘটনা তুমি সামনে থাকতে ঘটল? তোমার চাকরি তো সঙ্গে সঙ্গে নট হওয়া দরকার।
আমি খুবই ভয় পাইলাম। সিগারেট চাবায়া খাইয়া ফেলছে। কী জানি হয়? আপা বাসায় আসামাত্র বললাম।
আপা বললেন, এই বয়সের বাচ্চারা যা দেখবে তাই মুখে দিবে। মুখে দিতে দিতে শিখবে কোনটা খাবার, কোনটা খাবার না। তোমার এত অস্থির হবার কিছু নেই। তবে আরো সাবধান থাকবে।
জয়নাল বলল, এই বলল? আর কিছু না। ধমকধমকিও করল না?
সগিরন বলল, আরেকটা কথা বলছেন, সেই কথা শুনার পরে দৌড় দিয়া বাথরুমে ঢুইক্যা খুব কাঁদছি।
জয়নাল বলল, কী কী?
সগিরন বলল, আপা বললেন, শোন সগিরন। আমি যতক্ষণ বাইরে থাকব ততক্ষণ বাবুর মা তুমি, এটা মনে রাখবে।
জয়নাল বলল, অজুর পানি দাও বউ। এক্ষণ যদি তোমার আপার জন্যে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ না পড়ি তাইলে পাপ হবে।
বাবুর ছবিটা দেখবেন না?
নামাজ পইড়া তারপর দেখব। ছবিটা বান্দায় আনার ব্যবস্থা করবা। ঘরে টানায় রাখব।
জয়নাল নামাজ শেষ করে বাবুর ছবি হাতে বসল। দীর্ঘ সময় ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, সালমার চেহারার সাথে কী যেন একটা মিল আছে। ঠিক না বউ?
সগিরন বলল, নাকটার মধ্যে মিল। চাপা নাক। সালমার নাকও চাপা ছিল।
জয়নাল বলল, ঠিক বলেছ। অবিকল সালমার নাক।
সগিরন বলল, চউখের মধ্যেও একটা মিল আছে। মিলটা ধরতে পারতেছি না।
জয়নাল বলল, সত্য বলেছ। চউখেও মিল আছে।
সালমা জয়নাল-সগিরনের একমাত্র মেয়ে। আজ থেকে তের বছর আগে দারুণ অভাবে পড়ে এক হাজার টাকায় মেয়েটাকে তারা বিক্রি করে দিয়েছিল। তখন সালমার বয়স ছিল তেরো মাস। এই বয়সে সালমাও অনেকগুলি কথা শিখেছিল–বাবা, মা, পানি…