শারমিন পাশে এসে দাঁড়াল।
ইমন বলল, তুমি খবরের কাগজ পড় না। তাই না?
শারমিন বলল, পড়ি না। টিভি চ্যানেলে খবরও দেখি না। তাতে সমস্যা কী?
কোনো সমস্যা নেই, তবে আজ কাগজে একটা মজার খবর ছিল।
শারমিন বলল, মজার খবর তুমি পড়ে মজা পাও। আমার মজার দরকার নেই।
ইমন বলল, আবদুল মজিদ নামে এক লোককে নিয়ে একটা স্টোরি করেছে। সে মিস মনোয়ারা নাম নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে মেয়েদের ম্যাসাজ করে বেড়াত। তার একটা ছবিও ছাপা হয়েছে। ছবিটা দেখ।
শারমিন অনেকক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। তার হাত-পা কাঁপছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে যাবে।
ইমন বলল, পুলিশ এই লোককে ছেড়ে দিয়েছে, কারণটা কী জানো? কোনো মেয়ে এই লোকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি না। তুমি কি সাক্ষ্য দেবে?
শারমিন বলল, না।
সে মেজখালার বাড়িতে গেল না। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করল না। বাথটাবে শরীর ডুবিয়ে সারাদিন শুয়ে রইল এবং মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদল।
ইমন সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল। কোমল গলায় বলল, যা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে মাথা গরম করার কিছু নেই। তুমি তো জেনেশুনে কিছু কর নি। মনটা ঠিক কর, চল দুজনে মিলে কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করি। যাবে? শারমিন ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, না।
আজ সোমবার। ম্যাসাজের দিন।
সকাল থেকেই শারমিনের অস্থির লাগছে। অনেক চেষ্টা করেও সে অস্থিরতা দূর করতে পারল না। একসময় সে টেলিফোন করল।
হ্যালো! মিস মনোয়ারা?
ওপাশ থেকে কেউ কিছু বলল না।
মিস মনোয়ারা?
হুঁ।
আমি শারমিন। আজ ম্যাসাজের দিন। আপনি আসবেন না?
আসতে বলছেন?
হুঁ।
আচ্ছা, চলে আসছি।
শারমিন অপেক্ষা করছে। তার শরীরের দুশ আঠারোটা নার্ভ এন্ডিং ছটফট করছে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
এত দেরি হচ্ছে কেন? কখন আসবে মিস মনোয়ারা?
সগিরন বুয়া
সগিরন ধানমণ্ডি তিন নম্বর রোডের একটা ফ্ল্যাটে কাজ পেয়েছে। বাচ্চা রাখার কাজ। বাচ্চার বয়স তের মাস। নাম টুলটুল। টুলটুল হাঁটতে পারে। অনেক কথা বলতে পারে। যেমন দুদু, মা, বাবা, পিপি। টিভিতে গানের যে-কোনো অনুষ্ঠান হলেই সে হাত নাড়ে, শরীর দোলায়।
টুলটুলের মার নাম রেশমী। পুতুলের মতো দেখতে একজন মহিলা। তিনি এবং তার স্বামী দুজনই অফিসে কাজ করেন। সগিরনের দায়িত্ব হচ্ছে, তারা দুজন যখন থাকেন না তখন টুলটুলের দেখাশোনা করা। সগিরন ভোর আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করে নিজের বাসায় চলে যেতে পারবে।
তোমাকে মাসে পনেরো শ টাকা দিব। চলবে?
সগিরনের বুকে ধাক্কার মতো লাগল। এতগুলি টাকা? সে বিড়বিড় করে বলল, চলবে আম্মা।
আমাকে আম্মা বলবে না। আপা বলবে। আর টুলটুলের বাবাকে স্যার বলবে।
জি আচ্ছা।
বাসায় একজন বাবুর্চি থাকবে, একজন পিওন থাকবে? ওদের দুজনের কাছে মোবাইল ফোন আছে। বাবুর কোনো সমস্যা হলেই ওদেরকে বলবে। ওরা আমাকে জানাবে।
জি আচ্ছা।
বাবু যদি কোনো কাচের জিনিস, ফুলদানি এইসব ধরতে যায় তাহলে বলবে, নো, নো, নো। তিনবার নো বললেই আর ধরবে না। বুঝেছ?
জি।
বাবু যখন বলবে নি নি তার মানে সে পানি খেতে চায়। বাবুর পানি আলাদা আছে। বাবুর্চিকে বললেই দিবে।
জি আচ্ছা।
সকালে কাজ করতে এসে প্রথমেই বাথরুমে ঢুকবে। সেখানে তোমার জন্যে ধধায়া শাড়ি, সায়া ব্লাউজ সব থাকবে। তুমি ভালো করে সাবান দিয়ে গোসল করে দাঁত মাজবে, তারপর নতুন শাড়ি পরে এসে বাবুকে ধরবে। কাজ শেষ করে যাবার সময় এখানকার কাপড় রেখে যাবে। ঠিক আছে?
জি।
তোমার হাতের নখ কি কাটা আছে? নখ দেখি। নখ কাটাই আছে। আচ্ছা যাও, কাজে লেগে যাও। বাথরুমে ঢুকে পড়। টুথপেস্ট ব্রাস সবই আছে। একটা শ্যাম্পুও আছে। চুলে শ্যাম্পু দিও। নয়তো মাথায় উকুন হবে। সেই উকুন বাবুর মাথায় যাবে। বুঝেছ?
জি।
এখন এই দুটা ট্যাবলেট পানি দিয়ে গিলে ফেল। কৃমির ট্যাবলেট। বস্তিতে যারা থাকে তাদের সবার পেটভর্তি কৃমি। তুমি বস্তিতে থাক না?
জি।
স্বামী আছে?
আছে।
স্বামী কী করে?
রিকশা চালাইত, এখন পায়ে দুঃখু পাইছে। ঘরে বসা।
ছেলেমেয়ে আছে?
জে-না।
যে বস্তিতে থাক তার ঠিকানা লিখে পিওনের কাছে দাও।
আপা, লেখাপড়া জানি না।
পিওনকে ঠিকানা বলো সে লিখে নিবে।
জি আচ্ছা।
টুলটুলের বাবা সিগারেট খায়। সে যখন সিগারেট ধরাবে তখন বাবুকে তার ধারেকাছে নেবে না। মনে থাকবে?
থাকবে।
প্রথমদিন কাজ শেষ করে সগিরন বস্তিতে ফিরল। সগিরনের স্বামী জয়নাল বলল, কাজ পাইছ, শুকুর আলহামদুল্লিাহ্! কী কাজ কী সমাচার বলো শুনি।
সগিরন আগ্রহ নিয়ে গল্প করছে। মুগ্ধ হয়ে শুনছে জয়নাল।
বাচ্চাটা কী যে সুন্দর। আমি আমার জন্মে এমন সুন্দর বাচ্চা দেখি নাই। আমারে বাদ দেও, কেউ দেখে নাই। কী সুন্দর হাসি। যখন হাসে কইলজার মধ্যে মোচড় দেয়।
কান্দে না?
কদাচিৎ। এইটুক বাচ্চা, কী যে বুদ্ধি!
জয়নাল বলল, মাশাল্লা বলো। সবসময় মাশাল্লা বলবা।
সগিরন বলল, মাশাল্লা। তার বুদ্ধির নমুনা শুনবেন? টেবিলের উপরে একটা পানির গ্লাস। বাবু দৌড় দিছে গ্লাস ধরবে। আমি বললাম, নো নো নো। বলার সাথে সাথে সে দাঁড়ায়া গেল। আমার দিকে চায়া এমন একটা হাসি দিল যে কইলজা পুইড়া গেল। আমার নিজের এমন একটা পুলা থাকলে বলতাম, যাও বাবা গ্লাস ধর। ইচ্ছা করলে ভাইঙা চাইর টুকরা কর, কিছু বলব না।