৩. সে প্রথম দিন যে লুঙ্গি পরে দেখা দিয়েছিল, এর বাইরে কিছুই পরে না। ইসলামুদ্দিন তাকে শার্ট-প্যান্ট জুতা কিনে দিয়েছিলেন, সে ছুঁয়েও দেখে নি।
৪. সে গল্প শুনতে খুবই পছন্দ করে, কিন্তু নিজ থেকে কোনো গল্প কখনোই করে না।
রাতে খাবার পর্ব শেষ হবার পর ইসলামুদ্দিনের প্রধান কাজ গল্প বলা। বক্র আদর্শ শ্রোতা। সে ঝিম ধরে গল্প শোনে। সমস্যা একটাই, সে হুঁ হা কিছুই করে না। একজন ঘনঘন হুঁ দিলে গল্প বলে মজা পাওয়া যায়। এই মজাটা ইসলামুদ্দিন পাচ্ছেন না। তাতে অবশ্যি তার সমস্যা হচ্ছে না।
বুঝলে বক্র! আমার জীবন কেটেছে দুঃখে দুঃখে। বিয়ে করেছিলাম, বাসর রাতেই বউ মারা গেল। কীভাবে মারা গেল শুনলে থ মেরে যাবে। সাপের কামড়ে। একেবারে বেহুলা-লখিন্দর গল্প। বেহুলা-লখিন্দরের গল্প জানো?
না।
বাসর রাতে কালনাগিনী লখিন্দরকে দংশন করেছিল। আমার বেলায় উল্টোটা হলো, আমার স্ত্রীকে দংশন করল। সে যখন উহ্ করে উঠল তখন আমি চমকে দেখলাম, কুচকুচে কালো একটা সাপ খাট থেকে নেমে গেল। এমনভাবে নামল যেন কিছুই হয় নি। সে জানেও না কী সর্বনাশ করে চলে গেল। এরচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা কি শুনাবে?
বক্র মাথা নাড়ল। সে শুনবে। ইসলামুদ্দিন সাপের কামড়ের চেয়েও অদ্ভুত এক গল্প শুরু করলেন। গল্প শেষ হতে রাত হয়ে গেল। ইসলামুদ্দিন বললেন, যাপ শুয়ে পড়। Early to bed early to rise is the way to be healthy and vise. কী বললাম, অর্থ বুঝেছ?
না।
পড়াশুনা শিখতে হবে। পড়াশুনা ছাড়া চলবে না। বাল্যশিক্ষা, এবিসিডির বই কিনে আনব। প্রতিরাতে এক ঘণ্টা পড়াশোনা, তারপর গল্প।
ইসলামুদ্দিন বইখাতা কিনে নিয়ে এলেন। জোরেশোরে পড়াশোনা শুরু হলো। বক্রেরও আগ্রহের কমতি নেই। অল্পদিনেই সে পড়তে শুরু করল–
জল পড়ে
পাতা নড়ে।
কালো জাম
লাল আম।
বায়ু বয়
ভয় হয়।
এক রাতে ঘুমুতে যাবার সময় ইসলামুদ্দিন দেখলেন, তাঁর বালিশের কাছে। পিতলের একটা লোটা। ইসলামুদ্দিন বললেন, এটা কী রে? (এখন তিনি বক্রকে আদর করে তুই ডাকেন।)।
বক্ৰ বলল, আপনার জন্যে এনেছি।
পিতলের লোটা দিয়ে আমি করব কী?
এটা পিতলের না।
পিতলের না তো কিসের?
সোনার। নদীর তলে পড়েছিল। আপনার জন্যে এনেছি।
ইসলামুদ্দিন বললেন, আরে রাখ রাখ, সোনা এত সস্তা না। নদীতে কেউ সোনার লোটা ফেলে রাখে না। মুখে এই কথা বললেও ইসলামুদ্দিন নিশ্চিত বুঝলেন, লোটাটা সোনার। ওজন খুব কম করে হলেও দুই কেজি হবে। সোনার ভরি এখন কত তিনি জানেন না। জানলে দুই কেজি সোনার লোটাটার দাম কত বের করে ফেলতে পারতেন।
বক্র।
হুঁ।
আমার মধ্যে কোনো লোভ নেই, এটা কি জানিস?
হুঁ।
লোটা যেখান থেকে এনেছিস সেখানেই রেখে আসবি।
এখন যাব?
হ্যাঁ, এখন যাবি।
আপনার তো টাকাপয়সা শেষ হয়ে যাচ্ছে। পরে খাবেন কী?
প্রয়োজনে ভিক্ষা করব। তুই তোর ললাটা নিয়ে বিদায় হ।
আরেকবার সে সোনার রাধাকৃষ্ণ মূর্তি নিয়ে উপস্থিত। দশ-বারো কেজি ওজন। এতই সুন্দর যে চোখ ফেরানো যায় না। কৃষ্ণের চোখে কোনো নীল মণি বসানো। চোখ থেকে নীল আলো বের হচ্ছে।
ইসলামুদ্দিন বললেন, এটা কী জন্যে এনেছিস? আমি কি পূজা করব না-কি?
বক্ৰ বলল, দেখার জন্য এনেছি। সুন্দর না?
হ্যাঁ সুন্দর। যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে আয়। কোথায় ছিল?
নদীর তলে। পুরনো একটা ভাঙা জাহাজ আছে। তার ভেতরে ছিল। আরো অনেক কিছু আছে। দেখবেন?
না। বক্র শোন, আমাকে লোভ দেখাবি না।
আচ্ছা। আপনাকে খুশি করতে ইচ্ছা করে।
আমাকে খুশি করতে ইচ্ছা করলে নিজের সম্পর্কে বল। তুই আসলে কী? তোর বাবা-মা কে? এইসব।
বলব না।
আচ্ছা যা বলিস না। বই নিয়ে বোস।
পাঁচ বছর পরের কথা। ইসলামুদ্দিনের শরীর খুবই খারাপ করেছে। একচোখে কিছুই দেখেন না। অন্যচোখে আবছা দেখেন। হাঁপানির সমস্যা হয়েছে। দিনের মধ্যে কয়েকবার হাঁপানির টান ওঠে, তখন তার মরে যেতে ইচ্ছা করে।
দিনে হাঁপানির টান উঠলে বড়ই কষ্ট। দেখার কেউ নেই। রাতে বক্র পাশে থাকে। বুকে রসুন দিয়ে জ্বাল দেয়া সরিষার তেল মালিশ করে দেয়। তালের পাখায় হাওয়া করে। তখন একটু আরাম লাগে।
পৌষ মাসের এক সকালে ঢাকা থেকে তার এক সহকর্মী আবুল কালাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আবুল কালাম হচ্ছে সেই ব্যক্তি যাকে তিনি ব্যবসার জন্যে ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলেন। আবুল কালাম বললেন, একী অবস্থা!
ইসলামুদ্দিন চাদর গায়ে রোদে বসেছিলেন। তিনি ক্ষীণগলায় বললেন, কে?
আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি আবুল কালাম।
ও আচ্ছা।
আপনার এই অবস্থা তা তো জানি না। জানলে আগেই আসতাম।
ইসলামুদ্দিন বললেন, জনাব, আপনার পরিচয়?
আবুল কালাম বললেন, কী আশ্চর্য! চিনতে পারছেন না?
ইসলামুদ্দিন বললেন, চিনেছি। চিনব না কেন? তবে ঠিক…
আপনার দেখাশোনা কে করে?
আমার এক পালকপুত্র আছে। সে-ই করে। তার নাম বক্র।
নাম বক্র? সে কোথায়?
দিনেরবেলা সে নদীর তলে থাকে। সন্ধ্যাবেলা উঠে আসে। সারারাত থাকে আমার সঙ্গে।
আপনার কথা কিছুই বুঝলাম না। নদীর নিচে থাকে মানে কী?
আমি নিজেও ঠিক জানি না। সে মানুষ না, অন্যকিছু।
আবুল কালাম বললেন, অন্যকিছুটা কী?
ভূত হতে পারে।
ভাই, কিছু মনে করবেন না, আপনার তো মনে হয় মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।
ইসলামুদ্দিন বলেন, হতে পারে। আমার স্ত্রী যখন সাপের কামড়ে মারা গেল, তখন একবার মাথা খারাপ হয়েছিল। বছরখানিক ছিল। তখন পশুপাখির কথা বুঝতে পারতাম।