ছেলে জবাব দিল না। হুট করে ঘরে ঢুকে বালতি নিয়ে বের হলো। হনহন করে রওনা দিল। ছেলে কাজের আছে। এত বড় বালতি ভর্তি করে পানি আনা তার কর্ম না। গামা পালোয়ানের ছেলে হলেও একটা কথা ছিল।
ইসলামুদ্দিন মোমবাতি হাতে সাবধানে ঘরে ঢুকলেন। খুবই আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, প্রতিটি কামরাই পরিষ্কার! দরজা-জানালা নেই, কিন্তু মেঝে ঝকঝক করছে। দেয়ালে মাকড়সার জাল নেই। পাটি পেতে আরাম করে রাত পার করে দেয়া যায়। বোঝা যাচ্ছে ঘর পরিষ্কারের কাজ এই ছেলেই করেছে। এক-দুই দিনে এই কাজ করা সম্ভব না। ছেলেটা মনে হয় কিছুদিন ধরেই এখানে আছে। রাতটা পার হোক কাল দিনেই একটা ব্যবস্থা করতে হবে। রাজপুত্রের মতো ছেলে বাবা-মার ওপর রাগ করে একা পড়ে আছে। কোনো মানে হয়! বাবা-মা নিশ্চয়ই নিঘুম রাত পার করছে।
শুকনো লতাপাতা জোগাড় করে ইট বিছিয়ে ইসলামুদ্দিন আগুন ধরিয়ে রান্না চড়িয়েছেন। ছেলেটা বালতি ভর্তি করে পানি নিয়ে এসেছে। বিস্ময়কর ঘটনা। রোগী পটকা ছেলে, দেখে মনেই হয় না গায়ে এত জোর।
ঘি থাকলে ফার্স্টক্লাস একটা খিচুড়ি হতো। যি কিনতে হবে। থালা কেনা। বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কলাপাতা কেটে আনি। কলাপাতায় করে খাব।
ছেলে কলাপাতা কেটে নিয়ে এল।
কাগজি লেবুর চার-পাঁচটা গাছ ছিল। দেখ তো বাবা, লেবু পাওয়া যায় কি। লেবু না থাকলে কচি দেখে কয়েকটা লেবু পাতা ছিঁড়ে নিয়ে এসো। খিচুড়িতে দিয়ে দেব। মারাত্মক বাস ছড়াবে।
ছেলেটা লেবু এবং লেবু পাতা দুইই নিয়ে এল। সে বসেছে একটু দূরে। আগ্রহ নিয়ে রান্না দেখছে। ইসলামুদ্দিন যতবারই তাকাচ্ছেন ততবারই সে চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিচ্ছে।
ইসলামুদ্দিন বললেন, পানি যা এনেছ আরাম করে একটা গেসিলও দেয়া যাবে। জার্নিতে শরীর নষ্ট হয়ে গেছে। গোসল করলে শরীর ফ্রেস হবে। খেয়েও আরাম পাৰ। তুমি কি আজ গোসল করেছ?
আমি গোসল করি না।
তোমার কথা কিছুই বুঝলাম না। পানি খাও না, গোসল করো না। বাবা শোন, রান্না হয়ে গেছে। তুমি এখানে এসে বসো। আমি চট করে গায়ে একটু পানি দিয়ে আসি। তারপর আরাম করে খানা খাব।
ইসলামুদ্দিন সময় নিয়ে গোসল করলেন। তাঁর কাছে মনে হলো, দীর্ঘদিন গোসল করে এত আরাম পান নি। ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসার মতো আরাম।
খেতে এসে তিনি ছেলেটাকে পেলেন না। কোথাও নেই। তিনি এই খোকা, এই খোকা বলে অনেক ডাকাডাকিও করলেন। অদ্ভুত ছেলে তো! কিছু না বলে কোথায় চলে গেছে। ইসলামুদ্দিনের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তার ধারণা হলো, ছেলেটার মাথায় কিছু দোষ আছে।
খিচুড়ি খেতে খুবই সুস্বাদু হয়েছিল, কিন্তু তিনি খেয়ে একেবারেই আরাম পেলেন না। ছেলেটার জন্যে খারাপ লাগছে। বেচারা না খেয়ে কোথায় ঘুরছে কে জানে!
ইসলামুদ্দিন মেঝেতে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। নদীর বাতাস। কার্তিক মাসের ঠান্ডা হাওয়া। কানের কাছে মশার গুনগুনানি নেই। আহ্, কী শান্তি! ঘুমে যখন চোখ জুড়িয়ে আসছে, তখন দেখলেন তাঁর পাশেই ছেলেটা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। কোন ফাঁকে এসে শুয়ে পড়েছে কে জানে! ইসলামুদ্দিন বলতে যাবেন–খিচুড়ি রাখা আছে খেয়ে আস–তার আগেই ঘুমিয়ে পড়লেন। এক ঘুমে। রাত পার। ভোরে উঠে দেখেন ছেলেটি নেই।
সারাদিন ইসলামুদ্দিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটালেন। কাঠমিস্ত্রি এনে দরজা ঠিক করানো, চৌকি কেনা, মশারি কেনা, থালাবাসন কেনা। একসঙ্গে অনেকগুলি টাকা বের হয়ে গেল। উপায় কী? যখন নিঃস্ব হয়ে পড়বেন তখন দেখা যাবে। কপালে যদি ভিক্ষাবৃত্তি লেখা থাকে ভিক্ষাবৃত্তি করবেন। উপায় কী?
সিরাজউদৌলার মতো মানুষকে বলতে হয়েছিল উপায় নেই গোলাম হোসেন। তিনি কোন ছার!
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘুমুতে এসে দেখেন, নতুন কেনা চৌকিতে পা ঝুলিয়ে ছেলেটা বসা। তার মুখ হাসিহাসি। সে পা দোলাচ্ছে। নতুন কেনা হারিকেনের আলো পড়েছে ছেলেটার মুখে। সুন্দর দেখাচ্ছে।
বাবা, তুমি সারাদিন কোথায় ছিল?
ছেলে জবাব দিল না। তার পা দোলানো আরো দ্রুত হলো। ইসলামুদ্দিন বললেন, আমার মতো বৃদ্ধ একজন মানুষকে তুমি মহাদুশ্চিন্তায় ফেলেছিলে। কাজটা তো ঠিক করো নাই। রাতের খাওয়া কি হয়েছে? না হয়ে থাকলে বলো ভাত চড়াব, একটা ডিম ভেজে দিব! যা বেঁধেছিলাম সবই খেয়ে ফেলেছি।
আমি খাই না।
আবার ফাজলামি শুরু করেছ? মানুষ মাত্রই ক্ষুধার প্রাণী। তাকে খেতে হয়।
আমি মানুষ না।
তুমি মানুষ না, তাহলে তুমি কী?
আমি ভূত।
তোমাকে থাপ্পড় দেয়ার টাইম হয়ে গেছে। দুই গালে দুই থাপ্পড় দিলে স্ট্রেইট লাইন হয়ে যাবে। স্ট্রেইট লাইন বুঝ?
না।
স্ট্রেইট লাইন হলো সরলরেখা। যারা বক্র থাকে, তাদেরকে চড়-থাপ্পড় দিয়ে সরুল করতে হয়। তুমি বক্র।
আমি বক্ত?
হ্যাঁ, তুমি মহা বক্র। এখন থেকে তোমাকে ডাকব বক্র।
আচ্ছা।
বক্র মনে হচ্ছে কথাবার্তায় খুবই আমোদ পাচ্ছে। তার মুখভর্তি হাসি। সে সমানে পা দোলাচ্ছে।
বক্রের ব্যাপারটা ইসলামুদ্দিন ঠিক বুঝতে পারলেন না। এবং মনে হয় বোঝার চেষ্টাও করলেন না। আবার এও হাতে পায়ে যে, তিনি আঁচ করতে পারছেন কিন্তু ভাব করছেন না। তিনি বক্রের বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়লেন। বক্রের কিছু কিছু জিনিস মেনেও নিলেন।
যেমন–
১. বক্র আসলেই কিছু খায় না।
২. তাকে দিনে কখনোই দেখা যায় না।