ইসলামুদ্দিন ঝিগাতলায় দুই কামরার বাসা ভাড়া করে থাকতেন। নিজেই রান্না করে খেতেন। বুধবার রাতে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, খালি গায়ে ভিক্ষা করছেন। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ির লম্বা লাইন। তিনি প্রতিটি গাড়ির দরজার সামনে দাড়িয়ে বলছেন, জনাব, দুই দিনের না খাওয়া। একটু দয়া করেন।
স্বপ্ন ভাঙার পরই তিনি ঠিক করলেন, দেশের বাড়ি চলে যাবেন। সেখানে বসতবাড়ি ছাড়া কিছু নেই। দশ বছর আগে একবার এসে দেখেছেন বসতবাড়ির। অবস্থা শোচনীয়। কিছু দরজা-জানালা লোকজন চুরি করে নিয়ে গেছে। কিছু ঘুণে খেয়ে নষ্ট করেছে। একতলা পাকা দালান ঝোপ-জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। দেয়ালে বড় বড় ফাটল। সেখানে নিশ্চয় সাপের আড। একটা রাত নিঘুম কাটিয়ে ফিরে এসেছেন।
বতিনি বসতবাড়ি বিক্রি করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কেউ কিনতে রাজি হয় নি। নদী ভাঙতে শুরু করেছে। আশেপাশের অনেক বাড়ি নদী টেনে নিয়েছে। এই বাড়িও নিবে। কার গরজ পড়েছে কেনার!
কার্তিক মাসের এক সন্ধ্যায় তিনি নিজ বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। আশেপাশের বাড়িঘর সবই নদী টেনে নিয়েছে। তারটাই টিকে আছে। বনজঙ্গলে ঢাকা দালান। মনে হচ্ছে, যে-কোনো মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়বে। ইসলামুদ্দিন ভীত চোখে নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাড়ির পাশেই নদী। নদীর পানি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছে। সেই শব্দ ভৌতিক শোনাচ্ছে। ঝোপঝাড়ে নিশ্চয়ই কামিনী ফুলের গাছ আছে। কামিনী ফুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সেই গন্ধটাও যেন। কেমন কেমন।
ইসলামুদ্দিন ঝোলা থেকে মোমবাতি-দেয়াশলাই বের করলেন। ট্রেন থেকে নেমেই তিনি বুদ্ধি করে মোমবাতি-দেয়াশলাই ছাড়াও একটা টর্চ কিনেছেন। খিচুড়ি রাধার জন্যে চাল-ডাল তেল-মসলা কিনেছেন। একটা সসপেন কিনেছেন। হারিকেন কেনার ইচ্ছা ছিল। হারিকেন পাওয়া যায় নি। যেভাবে অন্ধকার নামছে তাতে মোমবাতি জ্বালানো অর্থহীন। মোমবাতির আলো অন্ধকার দূর করবে না, বরং আরো বাড়াবে। দীর্ঘপথ হেঁটে আসায় শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। প্রচণ্ড পিপাসা বোধ হচ্ছে। জঙ্গুলে এই বাড়িতে পানি কোথায় পাবেন?
ডাব খান।
ইসলামুদ্দিন চমকে পেছনে তাকালেন। এগারো-বারো বছরের একটা ছেলে কাটা ডাব হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার খালি গী। পরনে লুঙ্গি। চেহারা মেয়েলি। মাথার চুল বড় বড়। চোখও বড় বড়। গায়ের রঙ ফর্সা। এত চমৎকার গায়ের রঙ গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় না। ফর্সা ছেলেপুলেও রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যায়।
তুমি কে?
ছেলেটা জবাব না দিয়ে ডাব বাড়িয়ে দিল। ইসলামুদ্দিন বললেন, তুমি কে? নাম কী?
ছেলেটা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আমি এই বাড়িতে থাকি।
এই বাড়িতে থাকি মানে? তুমি একলা থাক?
হুঁ।
কিছুই তো বুঝলাম না। তুমি বাচ্চা একটা ছেলে, এই ভাঙা বাড়িতে একা থাক, মানে কী?
ভাব খান।
ইসলামুদ্দিন ঘটনায় চমকে গিয়েছিলেন বলেই তৃষ্ণা ভুলে ছিলেন। ডাব দেখে তৃষ্ণা আকাশ স্পর্শ করল। ডাব এক চুমুকে শেষ করলেন। মিষ্টি পানি। ডাবের পানি এত মিষ্টি হয় না। ভেতরে শাস হলেই পানি মিষ্টি হয়। ইসলামুদ্দিন বললেন, তোমার বিষয়টা পরে জানব, আগে ডাবটা দুই ফাঁক করে নিয়ে আস। দেখি শাঁস আছে কিনা। বিরাট ক্ষুধা লেগেছে।
ছেলে ডাব নিয়ে অন্ধকার বাড়িতে ঢুকে গেল। দা দিয়ে ডাব কাটার শব্দ আসছে। ইসলামুদ্দিন স্বস্তি বোধ করছেন। তিনি নির্বান্ধব না। একজন কেউ আছে, যে এখন দা দিয়ে ডাব দুফাঁক করছে। একসঙ্গে অনেকগুলি ঝিঝিপোকা ডাকছে। তিনি একা থাকলে ঝিঝিপোকার ডাকেই অস্থির হয়ে যেতেন।
ডাব দুফাঁক করা বৃথা হয়েছে। কোনো শাস নেই। ছেলেটা লজ্জিত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে, যেন ডাবে শাঁস না থাকার অপরাধটা তার।
ইসলামুদ্দিন বললেন, বাবা, নাম কী তোমার?
ছেলেটা অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দিল, নাম নাই।
নাম কেন থাকবে না? নাম বলতে না চাইলে সেটা ভিন্ন কথা। তুমি কি সত্যি এখানে একা থাক?
হুঁ।
বাড়ি থেকে রাগ করে পালায়ে আসছ?
ছেলে জবাব দিল না। পায়ের নখ দিয়ে মেঝের মাটিতে আঁকিবুকি কাটতে লাগল। ইসলামুদ্দিন নিঃসন্দেহ হলেন, ছেলে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। এইজন্যেই নাম বলতে চাচ্ছে না।
কতদিন ধরে এখানে আছ?
মেলা দিন।
খাওয়া দাওয়া কী করো?
আমি খাই না।
কী বলে এই পাগলা ছেলে? না খেয়ে থাকবে কীভাবে? ইসলামুদ্দিন নিঃসন্দেহ হলেন, ছেলেটা আজই এসেছে। সারাদিন না খেয়ে আছে। ইসলামুদ্দিন বললেন, ঘটনা কী আমাকে খুলে বলো তো। পরীক্ষা খারাপ করেছ? বাবা বকা দিয়েছে? পালিয়ে চলে এসেছ?
আমি লেখাপড়া করি না।
লেখাপড়া করো না এটা তো ভালো কথা না। যাই হোক, এই বিষয়ে পরে কথা বলব। কোনো ভয় নাই, আমি নিজে তোমাকে তোমার বাবার হাতে তুলে দিয়ে আসব। তাকে বলব যেন বকাঝকা না করেন। ঠিক আছে?
ছেলে অন্যদিকে তাকিয়ে হাসল। ছেলের স্বভাব বিচিত্র। কখনোই মুখের দিকে তাকায় না।
ইসলামুদ্দিন বললেন, বাবা, আগুন জ্বালাতে পারবে? সঙ্গে জিনিসপত্র সবই আছে। খিচুড়ি বেঁধে ফেলব। দুজনে মিলে আরাম করে খাব। ভালো কথা, পানি আছে?
নদীর পানি।
নদীর পানিতে রান্না চলতে পারে, খাওয়া যাবে না। তুমি কি নদীর পানিই খাও না-কি?
আমি পানি খাই না।
বোকা ছেলে বলে কী? মরুভূমির প্রাণী যে উট, তাকেও পানি খেতে হয়। বিপদের দিনের জন্যে সে তার কুঁজে পানি জমা করে রাখে। আশেপাশে টিউবওয়েল আছে?