আপনে দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা পাইছিলেন?
না। আমি তখন উনার দলে ছিলাম না। পরে যোগ দিয়েছি। বউ শোন, তুমি আমারে আপনে আপনে কর, এইটা ভালো লাগে না। এখন থেকে তুমি না বললে আমি জবাব দিব না। ছবি দেখবা?
দেখব।
সিনেপ্লেক্স নামে ভালো ছবিঘর বানায়েছে। দেশে উন্নতি হচ্ছে না কথাটা ভুল। যাও সাজগোজ কর।
মিনুরে সাথে নিয়া যাই।
নাও সাথে নাও। মিনু হলো তোমার ডিপার্টমেন্ট। তোমার ডিপার্টমেন্ট নিয়ে তুমি কী করবা সেইটা তোমার ব্যাপার। আমার ডিপার্টমেন্ট আমার।
সুইটি সাজতে বসল। এখন আর বাথরুমের ঝাপসা আয়নায় মুখ দেখতে হয়। নতুন ড্রেসিং টেবিল কেনা হয়েছে। আয়নাটা ভালো। একটা মানুষ যত সুন্দর আয়নায় তারচেয়ে সুন্দর লাগে। এটা হলো আয়নার গুণ।
শ্রাবণ মাসের কথা। সুইটির সন্তান হবে। পরীক্ষায় পাওয়া গেছে সন্তান মেয়ে। সুইটি তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছে–সুরভী।
সুইটি এখন বেশির ভাগ সময়ই মেয়ের জন্যে কাঁথা বানিয়ে কাটায়। প্রতিটি কাথায় নানান ডিজাইন এবং এক কোনায় লেখা–মা সুরভী।
রাত প্রায় একটা। আবুল কাশেম রাতে বের হলে এগারোটার মধ্যে ফেরে। খুব দেরি হলে বারোটা। আজ এত দেরি হচ্ছে কেন? সুইটি অস্থির বোধ করছে। মানুষটা মহাবিপদের কাজ করে। একটু উনিশ-বিশ হলে জীবন নিয়ে টানাটানি। পাবলিক হয়ে গেছে পিশাচের মতো। মলম পার্টির একজনকে ধরেছিস, খুব ভালো কথা। পুলিশের কাছে দে। তোরা পিটিয়ে মেরে ফেলার কে? কোর্ট কাছারি হবে, তারপর সিদ্ধান্ত হবে।
রাত দেড়টায় সুইটি নফল নামাজে বসল। তার হাত-পা কাপছে। একটু আগে একটা ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটেছে। কাঁথা সেলাইয়ের একটা সুঁচ আঙুলে ঢুকে রক্তারক্তি হয়েছে। এইসব লক্ষণ খুবই খারাপ। যে মানুষ বারোটার মধ্যে ঘরে ফিরে সে কেন আসছে না?
সুইটির কাছে একটা মোবাইল টেলিফোন আছে। অনেকবার সে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। যতবারই সে টেলিফোন করে ওপাশ থেকে একটা মেয়ে মিষ্টিগলায় বলে, সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরে আবার চেষ্টা করুন।
সুইটির ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে থাপড়াতে। আবুল কাশেম তাকে sms করাও শিখিয়েছে। সুইটি দুটা sms করেছে। একটাতে লিখেছে–
Tumi Ashchona Keno?
(তুমি আসছ না কেন?)
আরেকটাতে লিখেছে—
Voi Lagche. Telephone Koro.
(ভয় লাগছে। টেলিফোন কর।)
sms-এর কোনো জবাব আসে নি।
সুইটি দশ রাকাত নফল নামাজ পড়ার জন্যে দাঁড়িয়েছিল। তিন রাকাত শেষ হতেই আবুল কাশেম ঘরে ঢুকে বলল, মিনু, গরম পানি দাও, গোসল করব।
সুইটি নামাজ ছেড়ে উঠে পড়ল। পরে পড়লেই হবে। মানুষটাকে ঠিকঠাকমতো গরম পানি দেয়া দরকার। মিনু পারবে না। গোসল শেষ করেই সে ভাত খেতে চাইবে। তরকারি গরম করতে হবে। আজ তার পছন্দের রান্না হয়েছে। কলিজা ভুনা।
ভাত খেতে খেতে আবুল কাশেম বলল, আজ ভালো বিপদে পড়েছিলাম। এক হারামজাদা মহাবিপদে ফেলেছিল। অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়েছি।
সুইটি আতঙ্কিত গলায় বলল, ঘটনা কী?
আবুল কাশেম বলল, হারামজাদাটা ব্যাগ, মোবাইল, মানিব্যাগ ঘড়ি সবই দিয়েছিল। চোখে মলম দিতে যাচ্ছি তখন বলল, ভাই, আপনার পায়ে ধরি, এই কাজটা করবেন না। আমি একটা কলেজের অংকের শিক্ষক, তারপরেও আপনার পায়ে ধরছি।
বলে সে সত্যি সত্যি পায়ে ধরতে এসেছে। আমার মনে মায়া হলো। চোখে মলম না দিয়েই সিএনজি গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে তাকে নিচে ফেললাম। এমনই কপাল, তখন গাড়ির স্টার্ট হয়ে গেল বন্ধ। এইদিকে হারামজাদা কলেজের প্রফেসারটা শুরু করেছে চিৎকার–মলম পার্টি! মলম পার্টি! চারদিক থেকে লোক আসা শুরু করেছে।
সুইটি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, তুমি কী করলা?
আবুল কাশেম বলল, আমি মানিব্যাগ আর মোবাইলটা পকেটে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। হারামজাদা প্রফেসরটাকে ধরলাম। বললাম, ভাই, কী হয়েছে? জায়গাটা অন্ধকার। সে আমি কে বুঝতে পারল না। শুধু বলল, ঐ গাড়িতে মলম পার্টি।
এর মধ্যে লোক জমা হয়ে গেছে। আমার দুই অ্যাসিসটেন্ট আর CNG-র ড্রাইভার গাড়ি ফেলে দিয়েছে দৌড়। তাদের পিছনে পাবলিক।
ধরা পড়েছে?
জানি না। আমি বেশিক্ষণ থাকি নাই। চলে এসেছি।
সুইটি বলল, বিরাট ভুল করেছ। চউখে মলম দেয়া উচিত ছিল।
আবুল কাশেম বলল, অবশ্যই উচিত ছিল।
সুইটি বলল, এরকম ভুল আর করবা না।
আবুল কাশেম বলল, না, এই ভুল আর হবে না। বৌ, কলিজা ভুনা অসাধারণ হয়েছে।
সুইটি স্বামীর পিঠে হাত রাখল। ভালোবাসায় তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে।
ভূত
চৌষট্টি বছর বয়সে ইসলামুদ্দিন ঢাকা ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি ধূপখালির দিকে রওনা হলেন। তাঁর সঙ্গে একটা সুটকেসে কিছু কাপড়চোপড়, টুথপেস্ট-টুথব্রাশ, সাবান। পকেটের মড়ি ঘরে ছয় হাজার তিনশ টাকা। প্যান্টের পকেটের মানিব্যাগে সাতশ একুশ টাকা এবং একশ টাকার দুটা প্রাইজবন্ড। ইসলামুদ্দিনের দীর্ঘ চাকরি জীবনের এই হলো সম্বল।
ঢাকায় তিনি ভালো চাকরি করতেন। রিটায়ার করেছিলেন ব্যাংকের ক্যাশিয়ার হিসাবে। পেনশন এবং গ্রাচুইটির টাকায় উত্তরায় পাঁচ কাঠা জমি কিনেছিলেন। জমির দখল নিতে পারলেন না। জানা গেল জমির মালিক তিনজনকে একই জমি বিক্রি করেছেন।
তিনি তার অফিসের এক কলিগকে (আবুল কালাম) ব্যবসায় খাটানোর জন্যে ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলেন। প্রথম দুমাস আট হাজার টাকা মুনাফা পেলেন। তৃতীয় মাস থেকে সব বন্ধ। এলসি খোলার কী ঝামেলায় না-কি সব টাকা লোকশান গেছে। নিজের পকেট থেকে টাকা ঢালতে হবে এমন অবস্থা।