আবুল কাশেম তার পার্টনারকে খুবই যত্ন করল। মোৰাইলে টেলিফোন করে রেস্টুরেন্ট থেকে পরোটা-কাবাব আনাল। মুরগির রোস্ট আনাল। আবুল কাশেমের মুখে সারাক্ষণই ওস্তাদ, ওস্তাদ। সুইটি ভেবেই পেল না একজন পার্টনার অন্যজনকে ওস্তাদ কেন ডাকবে?
হারুন চলে যাবার পর সুইটি বলল, লোকটা ভালো না।
কাশেম বলল, ভালো না বুঝলে কীভাবে?
সুইটি গলা নিচু করে বলল, সারাক্ষণ আমার বুকের দিকে তাকায়ে ছিল।
আবুল কাশেম বলল, কদুর মতো বুক বানায়েছ। বুকের দিকেই তো তাকাবে। ঢেকে চুকে বসবে না?
উনারে আমার পছন্দ হয় নাই।
পছন্দ হওয়ার দরকার কী? তুমি তো তার সাথে হাঙ্গা বসবা না।
সুইটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এইসব কী কথা বলেন?
আবুল কাশেম মুখের ওপর পত্রিকা ধরতে ধরতে বলল, কান্দনের চেষ্টা করবা না। আমার কাছে চোখের পানির ভাত নাই। তারপরেও যদি কাঁদতে মন চায়–বাথরুমে দরজা বন্ধ কইরা কান্দ। আমার কানে শব্দ না আসলেই আমার দিলখোশ।
বাথরুমে ঢুকে অনেক চেষ্টা করেও সুইটি কাঁদতে পারল না। তবে এই ঘটনার দিন দশেক পর সুইটি খুবই কাদল। পত্রিকায় আবুল কাশেমের ওস্তাদ হারুনের ছবি দেখে কাঁদল। হারুনকে পাবলিক পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। সেই ছবি ছাপা হয়েছে। ছবিতে সে হা করে আছে। চোখ খোলা। অবাক হয়ে কী যেন
দেখছে।
হারুনের মৃত্যুশোকে অধীর হয়ে সুইটি কেঁদেছে তা কিন্তু না। সে কেঁদেছে হারুনের মৃত্যু-বিষয়ক খবরের শিরোনাম পড়ার পর।
মলম পার্টির মূল নেতা
হারুন মিয়া জনতার হাতে নিহত।
হারুন মিয়া যদি মলম পার্টির নেতা হয়, তাহলে তার স্বামী কী? সে তো তাকে ওস্তাদ ওস্তাদ ডাকত।
আবুল কাশেম কয়েকদিন ধরে ঘরেই আছে! ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে চিন্তিত। খবরের কাগজ পড়ে এবং ঘুমিয়ে সময় কাটাচ্ছে। মাঝে মাঝে চা খাচ্ছে। ঘরে এখন চা বানানোর সরঞ্জাম আছে। সুইটি চা বানাচ্ছে। তার চা নাকি ভালো হয়। আবুল কাশেম বলেছে, তোমার চা বানানোর হাত ভালো। জগতের সবচেয়ে জটিল রান্না চা। যে চা রানতে পারে সে কোপ্তা কালিয়া সবই পারে। আমি ঘরে রান্নার ব্যবস্থা করব। অবসর পেলেই তোমাকে নিয়ে নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে চলে যাব। রান্নার জন্যে যা যা লাগে কিনে নিয়ে আসবা। খুশি?
সুইটি বলছে, জি খুশি। আপনার অবসর নাই এইটা বুঝলাম না। দিনরাত তো শুয়েই থাকেন। আপনার কাজটা কী?
একেকজনের কাজের ধারা একেকরকম। কবি-সাহিত্যিকরা কী করে? ঘরে বইসা থাকে। তারার কোনো অফিস নাই। আমারও অফিস নাই।
সুইটি ক্ষীণগলায় বলল, আপনের ওস্তাদ হারুন মিয়ার খবরটা পত্রিকায় পড়েছি।
আবুল কাশেম বলল, পড়েছ ভালো করেছ। তুমি খুশি তো? এখন আর কেউ তোমার বুকের দিকে তাকায়ে থাকবে না।
সুইটি বলল, কিছু মনে নিয়েন না। আপনেও কি মলমপার্টির লোক?
আবুল কাশেম বলল, আমি মলম পার্টি না ট্যাবলেট পার্টি এটা জানার তোমার প্রয়োজন নাই। আমি স্বামী হিসাবে রোজগার করে তোমার হাতে দিব। তুমি খরচ করবা। সংসার চালাবা।
সুইটি বলল, আমারে দেশে পাঠায়ে দেন।
আবুল কাশেম বলল, স্যুটকেস গোছাও আজই পাঠায়ে দিব। নিজে যেতে পারব না। বাসে তুলে দিব। আগের মতো মাসে মাসে হাতখরচা পাইবা। কোনো অসুবিধা নাই। এখন এককাপ চা বানায়া আন। তোমার হাতের চা ভালো।
সুইটির শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না। বাপের বাড়িতে তার বাবাও নেই মাও নেই। ভাইয়ের সংসারে ফিরে যাওয়া। ভাই গাঁজা খায়। গাঁজার সঙ্গে আরো কী কী যে খায়। সংসারে বিরাট অশান্তি। প্রতি রাতেই তাদের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া। একবার তার ভাই চ্যালাকাঠ দিয়ে ভাবির মাথায় বাড়ি দিল। মাথা ফেটে রক্তারক্তি। হাসপাতালে নিতে হলো। পুলিশ কেইস হতে গিয়েও হয় নি, কারণ সুইটির ভাবি সবাইকে বলেছে–কলঘরে পা পিছলে মাথা ফাটছে। সেই সংসারে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয়?
আবুল কাশেম স্ত্রীকে রান্নাবান্নার সব সরঞ্জাম কিনে দিয়েছে। এমনকি একটা প্রেসার কুকারও কিনেছে। একটা কাজের মেয়ে জোগাড় করেছে, নাম মিনু। মেয়েটার বয়স বারো-তেরো, কিন্তু বড়ই লক্ষ্মী। কাজে-কর্মেও পাকা। বাসা ঝাট দিয়ে মুছে ঝকঝকে করে রাখে।
স্বামীর সঙ্গে সুইটির যথেষ্ট ভাব হয়েছে। আবুল কাশেমের নিয়ে আসা মানিব্যাগ, ব্রিফকেইস, ব্যাগ এইসব প্রথম খুলে দেখতে সুইটির ভালো লাগে। সে বলেই দিয়েছে, আমারে আগে দেখাবেন।
ব্রিফকেস ভেঙে একবার একটা স্বর্ণের চেইন পাওয়া গেল। হাতে নিয়ে মনে হলো এক ভরির চেয়ে কম ওজন না। সুইটি সঙ্গে সঙ্গে তা গলায় পরে ফেলল। আবুল কাশেম কিছুই বলল না। তাকে দেখে মনে হলো সে খুশি।
আরেকবার চামড়ার কালো ব্যাগ খুলে পাওয়া গেল চারটা পাঁচশ টাকার। বান্ডেল। আনন্দে সুইটির যখন দম বন্ধ হয়ে আসছিল তখন দেখা গেল প্রতিটি বান্ডেলের প্রথম নোটটাই শুধু আসল। বাকি সব নোটের আকারে কাটা কাগজ।
সুইটি বলল, এর মানে কী?
আবুল কাশেম সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, জগতে কত কিসিমের কত ধান্ধার মানুষ যে আছে তুমি বুঝবা না। চাইরটা আসল নোট পাওয়া গেছে, এতেই আমি খুশি।
সুইটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি সত্যি যদি সবগুলি পাঁচশ টাকার নোট হইত!
আবুল কাশেম বলল, হবে ধৈর্য ধরতে হবে। আমাদের কাজ ছিপ দিয়ে মাছ ধরার মতো। বেশির ভাগ সময় পুঁটি, খইলসা, টেংরা উঠে। হঠাৎ হঠাৎ বিশাল বোয়াল। আমার ওস্তাদ হারুন মিয়া একবার দশ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। তার দলে ছিল চাইরজন। প্রত্যেকে সমান ভাগ পাইছে। দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার। ওস্তাদ নিজের জন্যে এক টাকাও বেশি রাখেন নাই। মানুষ তো এমনে এমনে ওস্তাদ হয় না। ভিতরে জিনিস থাকতে হয়।