মাসুম রহমান স্ত্রীকে পাশে নিয়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসেছেন। তার হাতে বিয়ারের ক্যান। নিজেকে সুখী সুখী লাগছে। সুখী ভাবারই কথা। দুটি মেয়েরই ভালো বিয়ে দিয়েছেন। শেষ বয়সের জন্যে আলাদা করে রাখা সঞ্চয়ের পরিমাণও যথেষ্টই ভালো। স্ত্রী-ভাগ্যেও তিনি ভাগ্যবান। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে স্ত্রীর সঙ্গে তার বড় ধরনের ঝগড়া হয়েছে এমন মনে করতে পারলেন না।
হেনা বলল, তোমাকে একটা কথা বলব?
মাসুম রহমান বললেন, কথা বলার অনুমতি লাগে না-কি!
অস্বস্তি বোধ করছি বলেই বলছি। অনেকদিন থেকেই বলতে চাচ্ছি কিন্তু বলতে পারছি না। আমার কেন জানি মনে হয় তুমি shrink করছ।
কী বললে?
তোমার হাইট কমছে। প্যান্টগুলি সব বড় লাগছে।
মাসুম রহমান বললেন, আসাদুজ্জামানের মতো কথা বলবে না।
হেনা বলল, আসাদুজ্জামানটা কে?
মাসুম রহমান বললেন, তোমার মতো একজন মূর্খ।
হঠাৎ রেগে গেলে কেন?
মূর্খের মতো কথা বললে রাগব না?
হেনা শান্ত গলায় বলল, আমি মোটেই মূর্খের মতো কথা বলছি না। তুমি যে shrink করছ এটা তুমি নিজেও জানো। তুমি সব জুতা ফেলে নতুন জুতা কিনছ। নতুন প্যান্ট কিনছ। আগের গুলি নিজে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছ।
মানুষ নতুন জুতা প্যান্ট কিনতে পারে না?
হেনা বলল, বাথরুমে ওজন মাপার যন্ত্র থাকে। হাইট মাপার কিছু থাকে না। তুমি গতমাসে হাইট মাপার যন্ত্র কিনে বাথরুমে রেখেছ।
মাসুম রহমান বললেন, শাট আপ ইউ বিচ।
রাগে মাসুম রহমানের হাত-পা কাঁপছে। বিয়ারের ক্যান স্ত্রীর মুখের উপর ছুড়ে মারতে ইচ্ছা করছে।
বাইরে রিজার্ভ শুরু হয়েছে। ঝড়ের প্রচণ্ড মাতামাতি।
হেনা বলল, আমি প্রতিদিন তোমাকে দেখছি বলে ধরতে পারছি না। তুমি কতটুকু খাটো হয়েছ বলবে? এটা কি কোনো নতুন রোগ? এর কি কোনো চিকিৎসা আছে?
মাসুম রহমান মুখ বিকৃত করে F অক্ষর দিয়ে কুৎসিত একটা ইংরেজি গালি দিলেন। তার হাইট ছিল পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। এখন হয়েছে চার ফুট নয় ইঞ্চি।
ফোর্টি নাইন।
ভালোবাসা
সুইটি বিয়ের পর স্বামীর ঘর করতে ঢাকা এসেছে। তার বয়স একুশ। সে ইন্টার পাশ করা মেয়ে। গায়ের রঙ ময়লা হলেও দেখতে সুন্দর। রূপচর্চার দিকে তার বিশেষ ঝোঁক আছে। সপ্তাহে একদিন সে হাতে এবং মুখে কাঁচা হলুদ বাটা মেখে বসে থাকে। মাসে একটা ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রিম তার লাগে।
সুইটির স্বামীর নাম আবুল কাশেম। সে ঢাকায় ব্যবসা করে। কী ব্যবসা সুইটি জানে না। মাসের শুরুতেই মানি অর্ডারে তার নামে সাতশ টাকা হাতখরচা আসে। এতেই সে খুশি। স্বামীর সংসার করতে আসার সময় সে কিছু উদ্বেগের মধ্যে ছিল। হাতখরচের টাকাটা বন্ধ হয়ে যায় কি-না।
আবুল কাশেম কাওরান বাজারে দুই কামরার ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। সুইটি স্বামীর সংসার দেখে ধাক্কার মতো খেল। ঘরে কোনো আসবাব নেই। দুটা তোশকের ওপর শোবার ব্যবস্থা। কাপড় রাখার আলনা নেই। দড়িতে কাপড় ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা। ড্রেসিং টেবিল নেই। বড় আয়না নেই। ক্ষণে ক্ষণে আয়নায় মুখ দেখা সুইটির ছোটবেলার অভ্যাস।
আবুল কাশেম বলল, সংসার শুরু করেছি। আস্তে আস্তে হবে। মুখ ভোতা করে থাকবা না।
সুইটি বলল, আয়না ছাড়া মুখ দেখব কীভাবে?
আবুল কাশেম বলল, বাথরুমে আয়না আছে। মুখ দেখতে চাইলে বাথরুমে চলে যাবে।
সুইটি বলল, বাথরুমের আয়নায় তো কিছুই দেখা যায় না।
কিছুই না দেখা গেলে আমি রোজ শেভ করি কীভাবে? এইটা লাগবে সেইটা লাগবে বলে আমাকে অস্থির করবা না। এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বিরাট টেনশনে আছি।
সুইটি বলল, রান্নাঘরে কোনো হাঁড়িপাতিলও তো নাই।
আবুল কাশেম বলল, রান্না নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। হোটেলের সঙ্গে ব্যবস্থা করা আছে। তিনবেলা খানা চলে আসবে।
আমি কিছু রানব না?
রান্ধার কিছু জানো? খামাখা প্যাচাল। একটা জিনিস রানবা, মুখে দিতে পারব না। হবে ঝগড়া। আমি ঝগড়ার পাবলিক না। বিরাট চিন্তায় থাকি। আমার দরকার শান্তি। বুঝেছ?
আবুল হাশেম বিরাট চিন্তায় থাকে–এটা সুইটির মনে হলো না। যে মানুষ এত চিন্তায় থাকে সে সারাদিন ঘুমাতে পারে না। সকালের নাশতা খেয়ে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে পড়ে। দুপুরের আগে তার ঘুম ভাঙে না। ব্যবসার কাজে সে সপ্তাহে এক-দুই দিনের বেশি বের হয় না। কী রকম ব্যবসা কে জানে। একদিন সুইটি জিজ্ঞেস করেছিল। আবুল কাশেম খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বিরক্ত মুখে বলেছে, কিসের ব্যবসা জেনে কী করবা? ব্যবসার পার্টনার হবা? তুমি তোমার কাজ করবা, আমি করব আমার কাজ।
সুইটি মিনমিন করে বলল, আমার আবার কী কাজ?
আবুল কাশেম বলল, কাজের কি অভাব আছে? মুখে ক্রিম ঘষবা। চুলে তেল দিবা। চুল আঁচড়াইবা। আমি যখন ঘুমায়ে থাকব তখন মাথা টিপ্যা দিবা। স্বামীর সেবা করবা। স্ত্রীর এইটাই সবচেয়ে বড় কাজ। স্বামীর সেবা।
আবুল কাশেমের ব্যবসার পার্টনার হরুিন নামের একজন একদিন বাসায় এল। ধূর্ত চেহারা। বেঁটেখাটো মানুষ। নীল রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছে। ক্ষণে ক্ষণে কারণ ছাড়াই পাঞ্জাবি দিয়ে নাক ঘষে। নাকের দুপাশ এই কারণেই হয়তো লাল হয়ে আছে। লোকটির চোখের দৃষ্টিও ভালো না। সুইটি লক্ষ করল, লোকটা কথা বলছে তার সঙ্গে, কিন্তু তাকিয়ে আছে তার বুকের দিকে। একবারও চোখ নামাচ্ছে না। এবং তার জন্যে কোনো অস্বস্তি বোধ করছে না।