না।
আসাদুজ্জামান চা শেষ করেছেন। তিনি বললেন, আপনি অনুমতি দিলে একটা পান খাব স্যার। পান সঙ্গেই আছে। আগে পানি খাবার অভ্যাস ছিল না। স্ত্রীর মৃত্যুর পর পান খাওয়া ধরেছি। উনার একটা স্মৃতি ধরে রাখা। আমার স্ত্রীর জর্দা দিয়ে পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল। স্যার, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? Just one humble request.
কী রিকোয়েস্ট?
কাউকে দিয়ে আমার হাইটটা মাপাবেন। দুবছর পর মিলিয়ে দেখবেন।
মাসুম রহমান তার সহকারীকে ডেকে রোগীর হাইট মাপতে বললেন।
আসাদুজ্জামান বললেন, একটা কাগজে এই হাইটটা লিখে নামটা সিগনেচার। করে রাখুন। আর আমার কাছে দিন। আমি যত্ন করে রাখব। আপনি হারিয়ে ফেলবেন।
মাসুম রহমান বললেন, আমার কাছেই রেকর্ডটা থাকবে। আমি হারাব না।
দুই বছর অনেক সময় স্যার।
যত সময়ই হোক, আপনার হাইট লেখা কাগজটা আমার কাছে থাকবে। আর যদি হারিয়েও ফেলি হাইট মনে থাকবে। চার ফুট নয় ইঞ্চি। অর্থাৎ ফোর্টি নাইন। হাফ সেঞ্চুরির এক কম। ভাই, এখন যান। আপনি আমার অনেক সময় নষ্ট করছেন।
এই পৃথিবীতে আমি একাই ছোট হচ্ছি, নাকি আরো অনেকে হচ্ছে, আমার জানার ইচ্ছা। টাকা থাকলে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতাম। বিজ্ঞাপনে লিখতাম, যাদের হাইট ক্রমাগত কমছে তারা যোগাযোগ করুন।
ভাই, আমি এখন উঠব।
আসাদুজ্জামানও উঠলেন। নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠলেন।
সিন্দাবাদের ভূতের প্রতীকী অর্থ আছে। অনেক সমস্যাই সিন্দাবাদের ভূতের মতো মানুষের ঘাড়ে চেপে থাকে। কিছুতেই সেই ভূত ঘাড় থেকে নামানো যায় না। আসাদুজ্জামান নামের মানুষটা মাসুম রহমানের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতোই চেপে বসল। কিছুদিন পর পর টেলিফোন। মাসে একবার চিঠি একটা চিঠির নমুনা–
জনাব অধ্যাপক মাসুম রহমান,
আসসালাম। আমি আসাদুজ্জামান চৌধুরী। শিবচর হাইস্কুলের প্রাক্তন অংক শিক্ষক। আশা করি আপনি আমাকে স্মরণে রেখেছেন। আমার উচ্চতাও আপনার মনে আছে, চার ফুট নয় ইঞ্চি। ফোর্টি নাইন। হাফ সেঞ্চুরির এক কম। এই তথ্য যেন ভুলে না যান সেই কারণেই পত্র দিলাম। একই সঙ্গে পাসপোর্ট সাইজ একটা ছবিও দিলাম। যখন আপনার সঙ্গে। আবার দেখা করব তখন যদি চিনতে না পারেন, এই জন্যেই ছবি। বড়দের সালাম এবং ছোটদের শ্রেণীমতো দোয়া এবং স্নেহাশীষ দিবেন।
ইতি
আসাদুজ্জামান চৌধুরী
(ফোর্টি নাইন)
সমস্যা এখানেই শেষ না। মাসুম রহমান তার জন্মদিনে ফুলের তোড়া এবং কার্ড পাওয়াও শুরু করলেন। আসাদুজ্জামান অফিস থেকে তার জন্মদিনের তারিখ জেনেছে। কার্ডে লেখা থাকে–
জন্মদিনের ফুলেল শুভেচ্ছা
ফোর্টি নাইন আসাদুজ্জামান
রোগী দেখার সময়ও প্রায়ই আসাদুজ্জামানকে দেখা যায়। রোগীদের সঙ্গে গুটিসুটি মেরে বসে পান খাচ্ছে। তবে দেখা করতে আসে না। ঘণ্টা দুই-তিন বসে থেকে চলে যায়। সে দূরে বসে থেকেও এমন একটা চাপ তৈরি করে যার ব্যাখ্যা চলে না। একজন মানসিক রোগী আশেপাশে আছে, তাকে লক্ষ রাখছে, ভাবতেই কেমন যেন লাগে।
দ্বিতীয় বছরে মাসুম রহমান রোগীর হাত থেকে বিশেষ উপায়ে মুক্তি পেলেন। সৌদি আরবে কিং ফয়সল হাসপাতালে চাকরি নিয়ে চলে গেলেন। চাকরির তৃতীয় বছরে হঠাৎ কুরিয়ারে আসাদুজ্জামানের চিঠি।
স্যার,
আসসালাম। অনেক কষ্টে আপনার ঠিকানা জোগাড় করেছি। আপনার সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হবার পর আমি আরো দ্রুততার সঙ্গে ছোট হতে শুরু করেছি। এখন আমাকে পিগমি মানবের মতো দেখায়। সঙ্গে ছবি পাঠালাম। বর্তমানের ছবি এবং পূর্বের ছবি। হাইট চার্ট জিরক্স করে পাঠালাম। এখন আমার কী করণীয়? বিষয়টির বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া উচিত। এমনও তো হতে পারে আমার ব্যাধি জীবাণু কিংবা ভাইরাসঘটিত। এক মানবদেহ থেকে আরেক মানবদেহে সংক্রামিত হওয়ার মতো।
যদি তাই হয় তাহলে এই ভয়াবহ ব্যাধি রোধ কল্পে ব্যাপক গবেষণা হওয়া উচিত।
প্লেগ সংক্রমণের সময় বিশ্বের বিশাল মানবগোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছিল। সেরকম পরিস্থিতি যদি হয় তাহলে দেখা যাবে মানবজাতি এক-দেড় ইঞ্চি সাইজে পরিণত হয়েছে। অবশ্য তার একটা সুবিধাও আছে–খাদ্যাভাব পুরোপুরি দূর হবে।
বিশাল দালানকোঠার প্রয়োজন হবে না। ম্যাচবক্সের সাইজের বাড়িঘরেই চলবে। নভোযানে চড়ে চন্দ্র এবং মঙ্গল। গ্রহের অভিযান তেমন ব্যয়বহুল হবে না। কারণ নভোযানের সাইজ হবে ছোট।
সমাজ বিজ্ঞানীদের উচিত বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করা।
স্যার, আপনার প্রতি আমার একটি বিশেষ অনুরোধ নিজের উচ্চতার প্রতি লক্ষ রাখবেন। আপনার সঙ্গে আমার নানানভাবে যোগাযোগ হয়েছে। খাটো হওয়া বিষয়টা ভাইরাসঘটিত হলে আপনার কিঞ্চিৎ আশঙ্কা আছে।
ইতি
আপনার স্নেহধন্য
ফোর্টি নাইন আসাদুজ্জামান
মাসুম রহমান সব কাগজপত্র ডাস্টবিনে ফেলে তিনবার বললেন, গাধা, গাধা, গাধা।
কী কুক্ষণেই না এই লোকের কথা মন দিয়ে শুনেছিলেন। তার উচিত ছিল প্রথম দিনেই তাকে কানে ধরে চেম্বার থেকে বের করে দেয়া। বদের বাচ্চা!
কিং ফয়সল হাসপাতালের চাকরি শেষ করে তিনি কানাডার একটা হাসপাতালে যোগ দিলেন। বেশকিছু বছর পার হলো। এর মধ্যে ফোর্টি নাইন আসাদুজ্জামান আর যোগাযোগ করল না। সম্ভবত ঠিকানা বের করতে পারে নি।
জানুয়ারি মাসের এক রাতের কথা। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। রিজার্ড হতে পারে এমন ঘোষণা আবহাওয়া অফিস দিয়েছে।