হামিদ কাজটা একা করে নাই। কমান্ডার সিদ্দিক সাহায্য করেছে। মেয়েটারে বস্তায় ভরতে বিরাট ঝামেলা হয়েছিল। সিদ্দিক কমান্ডারের হাত কামড় দিয়া করল রক্তারক্তি কাণ্ড।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পরেই কমান্ডার সিদ্দিক ধরা পড়েছিল মুক্তির হাতে। মুক্তির কমান্ডার তাকে জিজ্ঞেস করেছেন, তুমি সারাজীবনে কোনো ভালো কাজ কী করছ? একটা ভালো কাজের কথা বলো।
সিদ্দিক কমান্ডার বলেছে, ভালো কাজ কী করেছি, মন্দ কাজ কী করেছি আপনারে কেন বলব? এইটা তো রোজহাশর না। তবে আমার সঙ্গে যারা যারা ছিল প্রত্যেকের নাম ঠিকানা দিতেছি, পারলে এদেরও ধরেন। কাগজ-কলম আনেন, নাম লেখেন।
অনেকেই ধরা পড়েছে, হামিদ বাদ পড়েছে। আজ লোকজন তাকে সম্মান করে। ছোট ছোট পুলাপান পতাকা হাতে নিয়ে চিকন গলায় বলে, মুক্তিযোদ্ধা হামিদ জিন্দাবাদ। জীবনটা তার এইভাবে কাটবে সে নিশ্চিত। সমস্যা একটাই, সুধাকে দেখলেই মনে হয় সে সব জানে। রাধা যেভাবে থুথু দিত, সুধা মেয়েটাও সেভাবেই থুথু দেয়। মেয়েটা বড় হবার আগেই একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। সিদ্দিক কমান্ডার বলতেন–যা ইচ্ছা করবা। প্রমাণ রাখব না। হামিদ নিজেও কোনো প্রমাণ রাখতে চায় না। প্রমাণ খারাপ জিনিস। তার নাতনি সুধা প্রমাণ ছাড়া কিছু না।
এক দুপুরে অস্বাভাবিক গরম পড়েছে। কুয়াতলায় হামিদ হুইল চেয়ারে বসে আছে। এক ফোঁটা বাতাস নেই। কুয়ার অন্যপাশে সুধা খেলছে। কুটুর কুটুর পুটুর পুটুর করে নিজের মনে কথা বলছে। হামিদ হুইল চেয়ার নিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। তাকে দেখেই সুধা খেলা বন্ধ করে থু করে একদলা থুথু ফেলল। হামিদ হাত বাড়িয়ে সুধাকে ধরল। পরের ঘটনাগুলি মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল। কুয়াতে ঝপাং করে ভারি কিছু পড়ার শব্দ হলো। হামিদ এক দুই তিন করে একশ পর্যন্ত গুনল। কুয়ার ভেতর থেকে কোনো শব্দ আসছে না। হামিদ তখন আকাশফাটা চিৎকার দিল, বৌমা কই? বৌমা কই? আমার দাদু কুয়াতে পড়ে গেছে। বৌমা, ও বৌমা…।
ফোর্টি নাইন
অর্থপেডিক সার্জন মাসুম রহমান অবাক হয়ে রোগীর দিকে তাকিয়ে আছেন। রোগীর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। চুলে পাক ধরেছে। ছোটখাটো মানুষ। চাপা নাক। বালক বালক চেহারা। রোগীর অস্থির আচরণ, ক্রমাগত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কপালে ঘাম নেই, কিন্তু একটু পরপরই কপালের ঘাম মোছার ভঙ্গি করছে। গলা খাঁকারি দিচ্ছে।
মাসুম রহমান বললেন, আপনার সমস্যাটা আরেকবার বলুন তো।
রোগী টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, আমি ছোট হয়ে যাচ্ছি।
ছোট হয়ে যাচ্ছেন?
জি স্যার। যে হারে ছোট হচ্ছি তাতে আঠার বছর ছমাস পর আমার উচ্চতা হবে এক ফুট দেড় ইঞ্চি।
আপনার নাম?
আসাদুজ্জামান চৌধুরী।
কী করেন?
স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। ক্রমাগত ছোট হচ্ছি–এই টেনশনের কারণে ছাত্র পড়াতে পারছি না। চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন ঘরে বসে আছি।
বিয়ে করেছেন?
জি। স্ত্রী পাঁচ বছর আগে গত হয়েছেন। একটাই মেয়ে। মেয়েটার বিয়ে দিয়েছি। জামাই পল্লী বিদ্যুতে কাজ করে।
ছোট হতে শুরু করলেন কবে?
স্ত্রী-বিয়োগের পর। খুব শক পেয়েছিলাম। দুইদিন এক রাত না খেয়ে ছিলাম। আমার মনে হয় সেই শকে বডি সিস্টেমের কোনো গণ্ডগোল হয়ে গেছে।
চা খাবেন?
স্যার, আমি চা খাই না। তবে আপনি যখন বলছেন তখন খাব। স্যার কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?
না।
বিশ্বাস না করারই কথা। আমি মেডিসিনের এক প্রফেসরকে দেখিয়েছিলাম। উনি সরাসরি বলেছেন—
আপনার মানসিক সমস্যা। কোনো একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখান।
সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছিলেন?
জি-না। আমার কাছে মনে হয়েছে, কোনো একজন অর্থপেডিক ডাক্তার দেখানো ভালো। তিনি হাড় পরীক্ষা করে সহজেই ধরতে পারবেন সমস্যাটা কী। একজন মানুষ ছোট হতে হলে তার হাড় ছোট হতে হবে। লজিক তাই বলে। একজন অর্থপেডিক চিকিৎসক ব্যাপারটা সহজে ধরবেন।
মাসুম রহমান বেল টিপে চা দিতে বললেন। এই রোগী আজকের শেষ রোগী। ঘড়িতে বাজে নটা। বাড়ি ফিরে রিলাক্স করার সময়। আজ রাতে রেস্টুরেন্টে খাবার পরিকল্পনা ছিল। তার স্ত্রী হেনা টেলিফোন করে পরিকল্পনা বাতিল করেছে। তুমুল ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়বৃষ্টিতে বাইরে যেতে তার ইচ্ছা করছে না। ঘরেই বাদলা দিনের খাবার তৈরি হচ্ছে। ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ মাছের ডিম, গরুর মাংস।
চা চলে এসেছে।
আসাদুজ্জামান চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, স্যার, আমি যে ছোট হচ্ছি তার প্রমাণ সঙ্গে করে এনেছি। আপনি অনুমতি দিলে প্রমাণগুলি দেখাই।
কী প্রমাণ এনেছেন?
পাসপোর্ট নিয়ে এসেছি। পাসপোর্টে যে হাইট দেয়া এখনকার হাইট তারচেয়ে সাত পয়েন্ট দুই ইঞ্চি কম। স্যার, পাসপোর্টটা দেখাব?
না। পাসপোর্ট ছাড়া আর কী প্রমাণ আছে?
স্ত্রী-বিয়োগের সময়ের একটা প্যান্ট আর এখনকার একটা প্যান্ট নিয়ে এসেছি। পাশাপাশি ধরলেই বুঝবেন। মেলে ধরব স্যার?
দরকার নেই।
কাগজপত্রও সঙ্গে আছে। একবার শুধু যদি চোখ বুলাতেন! আপনার সময় নষ্ট করছি বুঝতে পারছি। আমি বিরাট সমস্যায় আছি। স্যার, কাগজপত্র দেখাব?
কী কাগজপত্র?
একটা চার্ট। আমি নিজেই গ্রাফের মতো করেছি। x অক্ষে হাইট, y অক্ষে বয়স। প্রায় সরলরেখা রিলেশনশিপ।
আপনি স্কুলে কী পড়াতেন? অংক?
জি স্যার। আমি B. Sc. টিচার। অংক আর সায়েন্স পড়াই। B. Sc.-তে উপরের দিকে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিলাম। M. Sc. পড়ার শখ ছিল। আর্থিক সংগতি ছিল না। চার্টটা কি দেখাব?