এর কারণটা কী? দাদার সাথে একী ব্যবহার? হামিদ ইচ্ছা করলেই ছেলেকে ঘটনাটা বলতে পারে। মেয়ে তার বাবার হাতে কয়েকটা চড় খেলেই সহবত শিখবে। তবে হামিদ এখনো ছেলেকে কিছু বলে নি। ঘটনার কারণ বের করা দরকার। কারণ নিশ্চয়ই আছে।
এক দুপুরে হুইল চেয়ারে হামিদ বসা। হামিদের উল্টাদিকে সুধা খেলছে। দুজনের মাঝখানে কুয়া বলে তাকে দেখা যাচ্ছে না, তবে তার গলা শোনা যাচ্ছে। কী একটা ছড়া বলছে,
ও কুটকুট কই যাস?
ভাত নাই পান্তা খাস
পান্তায় আছে শিং মাছ
সইয়ের বাড়িত বড়ই গাছ।
হামিদ ডাকল, সুধা। ও সুধা।
সুধা বলল, চুপ।
হামিদ হুইল চেয়ার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চাকার ঘরঘর শব্দ হচ্ছে। সুধা বলল, কাছে আসবি না, ছেপ দিমু।
হামিদ বলল, ছেপ কেন দিবা দাদু?
তুই পচা।
হামিদ থমকে গেল। মেয়েটার কথাবার্তা এরকম কেন? সে কি কিছু জানে? পুলাপানরা অনেক সময় অনেক কিছু জানে। ক্যামনে জনে বলা কঠিন। মেয়েটা আর কাউরে থুথু দেয় না। তাকে দেখলেই থুথু দেয়। রাধাও থুথু দিত। রাধার মুখও ছিল গোল। দুইজনের নামেরও মিল আছে। একজন রাধা আরেকজন সুধা। হামিদ সাবধানে হুইল চেয়ার নিয়ে এগুচ্ছে, এত সাবধানে যেন কোনো শব্দ পর্যন্ত হয়।
সুধা দাদাকে দেখে চমকে তাকাল। হামিদ বলল, দাদু, জাম খাইবা?
সুধা মুখ ভেংচি দিল। জিহ্বা বের করে সাপের মতো নাড়ছে। বদ মেয়ের এত বড় জিহ্বা? কেঁচি দিয়ে কচ করে জিহ্বাটা কেটে ফেললে মনটা শান্ত হতো। সেটা সম্ভব না। আদরের নাতনি। মেয়েটার বিষয়ে তার বাবা-মাকে বলা দরকার। শাসন করার দায়িত্ব বাবা-মার। দাদা-দাদির শাসন বাবা-মা নিতে পারে না।
রাতে খাবার সময় হামিদ বলল, বৌমা, মেয়েটারে একটু শাসন করা দরকার।
হামিদের ছেলের বউ মর্জিনা অবাক হয়ে বলল, আব্বাজান, শাসন করব কেন? এমন লক্ষ্মী মেয়ে। সারাদিন নিজের মনে খেলে।
হামিদ বলল, কিছু কিছু বাজে অভ্যাস হয়েছে। ছেপ দেয়। আবার মুখ ভেংচি দেয়।
কারে ছেপ দেয়?
আমারে।
বলেন কী! ঐ সুধা, সুধা। কাছে আয় দেখি। তুই দাদুরে ছেপ দেস?
হামিদ তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। কী জবাব দেয় শোনা দরকার। সুধা অবাক হয়ে একবার তার দীদার দিকে একবার তার মার দিকে তাকিয়ে বলল, না মা।
এমনভাবে বলেছে যে বিশ্বাস না করে উপায় নাই। বদ মেয়ে।
মর্জিনা বলল, আব্বাজান, আপনে মনে হয় ধান্দা দেখছেন। বয়সকালে মানুষ ধান্দা দেখে। সুধা মা, যাও দাদুরে আদর দেও। যাও।
হামিদ বিরক্ত মুখে বলল, আদর লাগবে না।
মর্জিনা বলল, অবশ্যই লাগবে। মা যাও। দাদুরে আদর দাও।
সুধা এগিয়ে গেল এবং থু করে থুথু ফেলল। হামিদ বলল, দেখলা কী করেছে?
মর্জিনা অবাক হয়ে বলল, কী করেছে?
ছেপ দিয়েছে দেখ নাই?
মর্জিনা বলল, ছেপ দেয় নাই। আপনি ভুল দেখছেন?
হামিদ নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করল। এরা কিছু বুঝতে পারছে না। রাধা যেভাবে গুথু দিত এই মেয়েও তাই করে। মেয়েটা দেখতেও রাধার মতো। গোল মুখ। নামেও মিল আছে–রাধা আর সুধা। সুধা নাম রাখা বোকামি হয়েছে। হিন্দুয়ানি নাম।
বয়সকালে মানুষের ঘুম কমে যায়। সারা রাত জেগে কাটাতে হয়। হামিদের হয়েছে উল্টাটা। রাতের ভাত খাওয়ার পর পরই তার ঘুম পায়। এক ঘুমে রাত কাবার। ঘুম আরামের হয় না, এই এক সমস্যা। আলতু-ফালতু স্বপ্ন। বেশির ভাগ স্বপ্নেই সিদ্দিক কমান্ডারকে দেখা যায়। স্বপ্নগুলি এত বাস্তব।
স্বপ্নে সিদ্দিক কমান্ডার এসে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙায়। রাগী গলায় বলে, খবর পাইছি মুক্তি আসছে। আর তুই ঘুমে? হাতিয়ার কই? হাতিয়ার নিয়া বাইর হ দেখি। আইজ আমরার খবর আছে।
স্বপ্নের পরের অংশ বড়ই কষ্টকর। ভারি হাতিয়ার কাঁধে নিয়ে বনেজঙ্গলে কাদায়-পানিতে মুক্তির ভয়ে ছোটাছুটি।
মাঝে মাঝে রাধার বিষয়টা স্বপ্নে আসে। একটা গামছায় কোনোমতে শরীর ঢেকে রাধা ঘরের কোনায় বসে আছে। বাস্তবে তার হাত পেছনদিকে বাঁধা থাকত, স্বপ্নে হাত থাকে খোলা। হামিদ ঘরে ঢুকতেই রাধা বলে, আপনারে বাপ ডাকলাম। আপনি আমার ধর্ম বাপ। আমারে দয়া করেন। তখন সিদ্দিক কমান্ডারের কথা শোনা যায় স্বপ্নে সিদ্দিক কমান্ডার হঠাৎ উদয় হয় এবং চাপা গলায় বলে, সংগ্রামের সময় দয়া মায়া শ্বশুরবাড়িতে বেড়াইতে যায়। বুঝছ রাধা? আরেকটা কথা, সংগ্রামের সময় বাপ মিলিটারি, আর কেউ বাপ না। আমরারে বাপ ডাইক্যা লাভ নাই। এখন আমরা তোমার স্বামী। এক স্ত্রী সাত স্বামী। একেক স্বামী একেক পদের। প্রত্যেককে সোহাগ করবা। ছেপ যদি দেও পরে বুঝবা।
শেষের দিকে মুক্তিদের অবস্থা ভালো হয়ে গেল। বলতে গেলে রোজ রাত্রেই মুক্তি আসে। একদিন সিদ্দিক কমান্ডার বললেন, আইজ রাতে আমরা পালায় রাজানগর বাজারে চলে যাব। সেখানে মিলিটারির ঘাঁটি আছে। আমরা নিরাপদে থাকব। সব তৈয়ার থাক। রওনা দিব মাগরেবের ওয়াক্তে।
হামিদ বলল, রাধারে কী করবেন? ছাইড়া দিবেন, না সাথে নিয়া যাবেন?
সিদ্দিক বলল, ছাইড়া দিব কোন দুঃখে! এই মেয়ে আমাদের সবেরে চিনে। মুক্তির কাছে খবর দিবে। বুঝেছ ঘটনা? রাধারে বস্তায় ভইরা হাওরের পানিতে ফেলায়া যেতে হবে। দশ-বারোটা ইট দিবা বস্তার ভিতরে, যেন না ভাসে। আর কাজটা করবা হামিদ।
হামিদ বলল, আমি কী জন্যে করব?
আমি অর্ডার দিছি এইজন্যে তুমি করবা। কমান্ডারের অর্ডারের উপরে কোনো কথা নাই।