পারব চেয়ারম্যান সাব।
তোমাদের জন্যে দেশ স্বাধীন হয়েছে–এখন আমরা যদি কিছু না করি সেটা হবে জাতির প্রতি বেইমানি।
এই ধরনের কথাবার্তা শুরু হলে চেয়ারম্যান সাহেব দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। আশেপাশে শ্রোতা থাকলে বক্তৃতা থামতেই চায় না, তখন হামিদ বড় অস্বস্তি বোধ করে। কারণ সে কোনোদিনই মুক্তিযুদ্ধ করে নাই। এরচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা, সে নাম লিখিয়েছিল রাজাকারে। তাদের কমান্ডারের নাম ছিল সিদ্দিক কমান্ডার। সিদ্দিক কমান্ডার ঠান্ডা মাথায় মানুষ জবেহ করত। এবং বলত–মানুষ জবেহ করার সময় খবরদার কেউ বিসমিল্লাহ বলবা না। শুধু বলবা আল্লাহু আকবার। যুদ্ধে যাবার সময়ও বিসমিল্লাহ বলে যাওয়া যায় না। তখনো বলতে হয় আল্লাহু আকবার। আবার ওষুধ খাওয়ার সময়ও বিসমিল্লাহ বলা যাবে না। বলতে হবে আল্লাহু শাফি। বুঝেছ সবাই? বুঝতে পারলে বুলন্দ আওয়াজে বলো, ইয়েস কমান্ডার।
তারা সবাই উঁচু গলায় বলত, ইয়েস কমান্ডার।
হামিদ যে রাজাকার দলে ছিল এটা তার অঞ্চলের কেউ জানে না। সংগ্রামের সময় সে ধানকাটার কাজ নিয়ে সিলেটের হাওর অঞ্চলে ছিল। সংগ্রাম শুরু হবার পর গাড়ি নৌকা সব বন্ধ। সে আটকা পড়ে। হাতে নাই পয়সা। মুক্তিতে যাওয়া যায়, কিন্তু মুক্তিতে টাকাপয়সা নাই। রাজাকারে গেলে সত্তর টাকা বেতন। লুটপাটের ভাগও আছে। এছাড়াও অন্য সুবিধা আছে। মিলিটারি এক অফিসার একবার ক্যাম্প দেখতে এসে তাদেরকে দুই বোতল বিলাতি দিলেন। আহা কী জিনিস! স্যরি ছিলেন লঞ্চে। তিনি বললেন, অল্পবয়সি দুটা মেয়েছেলে লাগবে। নানান ঝামেলা করে দুজন জোগাড় হলো। তারা স্যারের কাছে নিয়ে গেল। স্যার বললেন, আমার জন্যে তো চাই নাই। তোমাদের জন্যে চেয়েছি। তোমরা ফুর্তি কর। শুধু কাজ করলে হয় না। কাজের সাথে ফুর্তিও লাগে। বোতল খাও, বোতল নিয়া ফুর্তি কর। খাটি পাকিস্তানিদের জন্যে উপহার।
তারা দুজনকে নিয়ে ফুর্তি করতে পারে নাই। একজন কীভাবে যেন পালিয়ে গেল, অন্যটা পালাতে পারল না। তার নাম ছিল রাধা। চেহারা ভালো ছিল, তবে তেজ ছিল। আটদিন ছিল। আটদিনে কিছুই খায় নাই। এক ফোটা পানিও মুখে দেয় নাই। মেয়েটার ওপর হামিদের খানিকটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। সে অনেকবারই পানি খাওয়াতে চেষ্টা করেছে। যতবারই গেছে ততবারই বজ্জাত মেয়ে তার মুখে থুথু দিয়েছে। আসল হারামি। আদরের মর্যাদা বোঝে না।
দেশ স্বাধীনের পর সে একজোড়া বুটজুতা, খাকি শার্ট এবং প্যান্ট নিয়ে গ্রামে ফিরেছে। এবং মিনমিনে গলায় বলেছে মুক্তিতে নাম লিখায়েছিলাম। যুদ্ধে জীবন গেছে। জান নিয়া ফিরতে পারব ভাবি নাই। সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা।
গ্রামের মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তাকে যথেষ্টই সম্মান দিয়েছে। স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব তাকে একদিন স্কুলে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, তুমি তোমার অভিজ্ঞতার গল্প এদের বললা। এরা শিখবে। দেশমাতৃকার মূল্য কী বুঝবে।
হামিদ বিড়বিড় করে বলল, এইসব পুলাপানের বিষয় না।
হেড স্যার বললেন, এরা যুদ্ধের মধ্যে বড় হয়েছে। সবই এদের বিষয়। এদের জানা দরকার।
হামিদ গলা খাঁকারি দিয়ে যুদ্ধের গল্প শুরু করল। কীভাবে তারা একটা লঞ্চ অ্যাটাক করে সাতজন মিলিটারি মারল এবং একটা হিন্দু মেয়ে উদ্ধার করল। যদিও সে শেষ পর্যন্ত বাঁচে নাই।
হেড স্যার বললেন, নাম কী ছিল মেয়েটার? হামিদ চাপা গলায় বলল, রাধা।
হেড স্যার বললেন, আহারে! সবাই উঠে দাঁড়াও, রাধা মেয়েটার জন্যে এক মিনিট নীরবতা।
সবাই উঠে দাঁড়াল। হেড স্যার বললেন, গলা ফাটায়ে বলো জয় বাংলা। গলা চিরে যেন রক্ত পড়ে।
জয় বাংলা!
হামিদ যুদ্ধের গল্প বলা বন্ধ করে দিয়েছে অনেকদিন। সে গল্প সেইভাবে বানাতেও পারে না। কী বলতে গিয়ে কী বলবে এটা নিয়ে ভয়ও থাকে। একবার তো প্রায় ধরাই পড়ে গিয়েছিল। পত্রিকা থেকে এক লোক এসেছে ছবি তুলবে, ইন্টারভিউ নিবে।
ভাই, আপনি কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? আপনার সেক্টর কমান্ডারের নাম কী?
হামিদ থতমত খেয়ে বলল, লেখাপড়া জানি না তো ভাইসাহেব, কিছু ইয়াদও নাই। একবার মিলিটারির হাতে ধরা খাইলাম। তারা পায়ে দড়ি বাইন্ধা কাঁঠাল গাছে ঝুলায়া রাখল তিনদিন। তখনই মাথার গণ্ডগোল হয়েছে। কিছু মনে নাই।
যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তাদের নামও মনে নেই?
জে না। কিছুই ইয়াদ নাই। আমি আর কোনো কথা বলব না ভাইজান। কথা বললেই মাথায় যন্ত্রণা হয়।
এখন কিছুদিন হামিদের সত্যি সত্যি মাথার যন্ত্রণা হয়। মাথার যন্ত্রণা খুব বাড়লে সে চলে যায় কুয়াতলায়। কুয়াতলাটা পাকা। হুইল চেয়ার নিয়ে ঘুরতে আরাম। তাছাড়া বিশাল দুটা জামগাছ আছে। কুয়াতলা ছায়া হয়ে থাকে। গরমের সময় পাকা জাম টুপটাপ করে গায়ে পড়ে। গায়ে পড়া পাকা জামের স্বাদই আলাদা। কুয়াতলার একদিকে ঘুরে হামিদ, তার ঠিক অন্যদিকে ঘুরে তার নাতনি সুধা। সুধার বয়স আড়াই বছর। ফর্সা। গোলগাল মুখ। সুধীর মা সবসময় সুধীর চোখে কাজল এবং কপালে টিপ দিয়ে রাখে। যেন কেউ নজর দিতে না পারে।
সুধা আপন মনে রান্নাবাটি খেলে। বিড়বিড় করে হাত নেড়ে কথা বলে। হাসে। শুধু যখন হামিদ ডাকে, এই এই কাছে আয়– তখন সুধার চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। হামিদ যখন হুইল চেয়ার নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায় তখন সে চট করে উঠে দাঁড়ায় এবং হামিদের দিকে থু করে থুথু দেয়ার ভঙ্গি করে।