আধঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল, একঘণ্টা লেগে গেল। ট্রলি ঠিকমতো বসছে না। জার্ক হচ্ছে। ট্রলি শট বাদ দিয়ে জুম দিয়ে কাজ হবে। বাচ্চার ফ্রেম থেকে ওয়াইড হবে।
গায়ে ভ্যাসলিন মাখার পর থেকেই বাচ্চা কাদছে। শটের জন্যে ভালো। ডাইরেক্টর কামাল ক্যামেরা বললেন, ডাক্তারের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছেন তিনি বাচ্চার পা ধরে তাকে ঠিক সময়মতোই ফ্রেমে নিয়ে এলেন। জুমল্যান্স বাচ্চার মুখে ফোকাস করল। বাচ্চা শুরু করল বিকট চিৎকার। তখনি দুর্ঘটনা ঘটল। ডাক্তার মেয়ের হাত থেকে পিছলে বাচ্চা মেঝেতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার কান্না বন্ধ হয়ে গেল।
ডাইরেক্টর কামাল জাহেদার বাসায় এসেছেন। তিনি কথা বলে যাচ্ছেন। জাহেদা সেইসব কথা শুনছে না-কি শুনছে না তা বোঝা যাচ্ছে না। সে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। কামাল সাহেব বললেন, তোমার ছেলে হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। শট শুরু হবার আগেই তার হার্ট অ্যাটাক হয়। ডাক্তারের সার্টিফিকেটও আছে। চাইলে দেখাব। সার্টিফিকেটে লেখা–কজ অব ডেথ হার্ট অ্যাটাক। এইসব ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রশ্ন ওঠে না। কারণ হার্ট অ্যাটাকে মানুষের কোনো হাত নাই। তোমার ছেলে যদি তোমার কোলে শুয়ে থাকত তাহলেও হার্ট অ্যাটাক হতো। হার্ট অ্যাটাক এমনই জিনিস। যাই হোক, তারপরেও আমরা দশ হাজার টাকা দিলাম। এইখানে সই করে টাকাটা নাও। সই করতে না পারলে বুড়া আঙুলের টিপসই দাও।
জাহেদা টিপসই দিয়ে টাকা নিল। তার ছেলের প্রথম এবং শেষ রোজগার।
কুদ্দুস নয়া রিকশা কিনেছে। একটা টেবিলফ্যান কিনেছে। দিনে সে রিকশা চালায়। রাতে সে ফ্যানের বাতাসে ঘুমায়। ঠান্ডায় তার ভালো ঘুম হয়। জেগে। থাকে জীহেদা। রাত গভীর হলে সে ছেলের নামে ছড়া কাটে–
আমার ছেলে রিকশা বায়
রইদে পুড়ে আশুলিয়া যায়।
পঙ্গু হামিদ
পঙ্গু হামিদের বয়স ষাটের কাছাকাছি। চামড়া ঝুলে গেলেও শক্ত-সমর্থ। এখনো ঝুনা নারিকেলের খোসা মুহূর্তের মধ্যে খুলে ফেলতে পারে। গত কোরবানির সময় সে গরুর সিনা দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খেয়েছে, তেমন অসুবিধা হয় নি। তার একটাই অসুবিধা, সে হাঁটাচলা করতে পারে না। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় হুইল চেয়ারে যেতে হয়। হুইল চেয়ারটা দুবছর আগের, তবে এখনো নতুন। প্রতিদিন হামিদের ছেলের বৌ ঝাড়পোছ করে। কাউকে হাত দিতে দেয় না। অনেকেই দেখতে আসে। আগ্রহ নিয়ে বলে, সাইকেল চিয়ারটা একটু দেখাও। চলে ক্যামনে? মেশিং আছে?
হামিদের ছেলের বৌ মর্জিনা অহঙ্কারী গলায় বলে, মেশিং নাই, হাতে চলে।
আচানক জিনিস বানাইছে গো। কোমর ভাইঙ্গা পইড়া থাকলেও অসুবিধা নাই, সাইকেল চিয়ারে কইরা ঘুরবা। জিনিসটার দাম কত?
দাম কত জানি না। চেয়ারম্যান সাব সরকার থাইকা বন্দোবস্ত কইরা দিছেন। সাথে খোরাকির টেকাও পাইছেন। কত জানি না।
মর্জিনা জানে না কথাটা ঠিক না। খোরাকির টাকা মাসে একশ করে পাওয়া যায়। প্রতি তিন মাস পরে পরে চেয়ারম্যান সাহেবের খাতায় টিপসই করে টাকা আনতে হয়।
এলাকার চেয়ারম্যান হাজী শামসুদ্দিন চৌধুরী লোক ভালো। কৌশলের কাজকর্ম তার মতো কেউ জানে না। সে ছাড়া অন্যকেউ হামিদের জন্যে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করতে পারত না। ত্রিশ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, আর চেয়ার এসেছে সতের মাস আগে। হামিদ মুক্তিযুদ্ধে আহত হয় নাই। সে দুই বছর আগে কোমর ভেঙেছে কাঁঠাল পাড়তে গিয়ে পিছলে পড়ে।
চেয়ারম্যান হাজী শামসুদ্দিন চৌধুরী তিন জায়গায় চিঠি লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ
বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ পরিষদ, দেশ নামের এক এনজিও।
তিনি লিখেছেন, যাদের জন্যে আজ স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিত হয়েছে, ছোরান্তর গ্রামের হামিদ তাদের একজন। আজ হামিদের পরিচয় পঙ্গু। কোমর ভেঙে সে বিছানায় শুয়ে আছে তিন বছর। ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সারা জাতি যখন আনন্দ-সাগরে ভাসে, তখন হামিদ ভাসে অশ্রুজলে।
মুক্তিযোদ্ধার সরকারি তালিকায় তার নাম নেই, কারণ সে নামের পিছনে ছুটে নাই। বিশেষ বিশেষ দিনে যখন অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা এসে তাকে কদমবুসি করে গলায় জবা ফুলের মালা পরিয়ে দেয় তখন সে বলে, আমার মানব জন্ম সার্থক।
স্বাধীন দেশে আমরা ছুটাছুটি করে বেড়াব, আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে হায়েনা হিসাবে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা হামিদ পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদবে। এই কি বিচার?
চেয়ারম্যান হাজী শামসুদ্দিনের জ্বালাময়ী প্রতিবেদন এবং নানান জায়গায় ছোটাছুটির কারণে দেশ এনজিও একটা হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করেছে। সঙ্গে এককালীন দশ হাজার টাকা। হাজী শামসুদ্দিন হুইল চেয়ারটা দিয়েছেন, টাকাটা রেখে দিয়েছেন। তিনি হামিদকে বলেছেন, হুইল চেয়ারের সঙ্গে লোক দেখানো কিছু টাকাও দিয়েছে। সেই টাকা আর তোমাকে দিলাম না। হুইল চেয়ার রিলিজ করতে এরচেয়ে বেশি টাকা নিজের পকেট থেকে গেছে। বুঝেছ?
বিনয়ে গলে গিয়ে হামিদ বলেছে, বুঝেছি স্যার।
হাজী সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেছেন, পাবলিকের সেবা করতে গিয়ে নিজে হচ্ছি পথের ফকির। এটা কপালের লিখন ছাড়া আর কিছু না। যাই হোক, চেষ্টায় আছি তোমার জন্যে বয়স্কভাতার ব্যবস্থা যাতে করা যায়। মাসে দুশ টাকা পাবে আজীবন। এর মধ্যেও ভেজাল আছে। কয়েকজনকে টাকা খাওয়াতে হবে। চারহাজার টাকা পান খাওয়ার জন্যে দিতে হবে। তুমি দুই হাজার দাও। বাকিটা আমি নিজের পকেট থেকে ম্যানেজ করব। পারবা না?