দুপুরের খাবারটা তিনি খুব আরাম করে খেলেন। তেহারি ছিল গরম এবং সুস্বাদু। তেহারির সঙ্গে সালাদ ছিল। সালাদের কাঁচামরিচ যথেষ্ট ঝাল। ঝাল মরিচের সঙ্গে গরম তেহারির তুলনাই হয় না। খাওয়া শেষ করে তিনি জর্দা দিয়ে পান খেলেন। একটা সিগারেট খেলেন। ভাড়া করা বালিশে মাথা এলিয়ে শুয়ে পড়লেন।
জেমস বলল, টিপার পুলাপান দিব স্যার? শইল টিপ্যা ঘুম পাড়ায়ে দিবে। পাঁচ টেকা নিবে। ডাকব স্যার?
তিনি বললেন, আচ্ছা ডাক।
তার কাছে এখন হঠাৎ মনে হচ্ছে তিনি আনন্দে আছেন। স্মৃতিশক্তি ফিরে আসার পর এই আনন্দ আর নাও থাকতে পারে। হয়তো জানা যাবে তার মাথা খারাপ ছিল। তাকে একটা ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হতো। হঠাৎ সুযোগ পেয়ে তিনি পালিয়ে গেছেন।
কিংবা জানা যাবে তিনি বাস করেন গুলশানে। লেকের পাড় তার বাড়ি। রোজ সন্ধ্যায় তিনি স্ত্রীর সঙ্গে লেকের পানি দেখতে দেখতে চা খান।
এক ঘুমে তিনি বাকি দিন পার করলেন। গা টেপা ছেলেটা চলে গেছে। মাথার নিচের বালিশটাও নেই। পকেটের টাকা এবং টাকার সঙ্গে রসমালাই লেখা কাগজের টুকরাটাও নেই। কে লিখেছিল লেখাটা? তার বড় মেয়ে?
আঙ্কেল, কিছু লাগব?
তিনি চমকে তাকালেন। তার সামনেই অল্পবয়সি একটা মেয়ে ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক মেখে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে ঠোঁট নিগ্রো মেয়েদের মতো মোটা এবং কালো দেখাচ্ছে। মেয়েটার পরনে লাল শাড়ি। শাড়ির লাল রঙ টের পাওয়া যাচ্ছে। হাতে বেলিফুলের মালা জড়ানো।
লাগব কিছু আঙ্কেল? আমার বয়স কিন্তু কম। পিপটিন। পনেরো বছর।
আমার কিছু লাগবে না। তোমার নাম কী?
মেয়েটা বেঞ্চিতে বসতে বসতে বলল, একেক দিন একেক নাম নেই। আইজ আমার নাম কমলা।
তিনি বললেন, কমলা, আমি একটা বিরাট বিপদে পড়েছি। কী বিপদ তোমাকে বলতে পারছি না। কারণ তুমি কিছু করতে পারবে না।
কমলা বলল, চা খাইবেন?
চা খাব না। আমার পকেটে টাকাপয়সা নেই। সামান্য যা ছিল কে যেন নিয়ে গেছে।
কমলা বলল, চায়ের পয়সা আমি দিব। চা খান।
তুমি চা খাওয়াবে?
দোষ কী? খাওয়াইলাম এক কাপ চা।
তিনি ধরা গলায় বললেন, কমলা! তুমি যাই কর না কেন তুমি অতি ভালো একটা মেয়ে। আমার মেয়ের মতোই ভালো।
আপনার একটাই মেয়ে?
জানি না কমলা।
জানেন না কেন?
জটিল ঝামেলায় পড়েছি কমলা।
কমলা বিস্মিত গলায় বলল, কানতেছেন কেন?
তিনি জবাব দিলেন না। রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন।
রাত এগারোটা। হালকা বৃষ্টি পড়ছে। দোকানপাট সব বন্ধ। রাস্তা ফাঁকা। এলিফ্যান্ট রোডের চশমার দোকানগুলির সামনে তিনি দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছেন। তার প্রচণ্ড ভয় লাগছে।
নয়া রিকশা
জাহেদা তার ছেলের নাম রেখেছে–জাহেদুর রহমান খান। মায়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম। ছেলের নামে যদি মায়ের নামের মিল থাকে, তাহলে বেহেশতে মা ছেলের দেখা হয়। এটা তুচ্ছ করার বিষয় না। লাখ লাখ মানুষ বেহেশতে যাবে। কারণ লাখ লাখ মানুষ উপাসী। বেহেশত উপাসী মানুষদের জন্যে পুরস্কার। মাওলানা সাহেবের নিজের মুখের কথা। লাখ লাখ মানুষের মধ্যে জাহেদা তার ছেলেকে খুঁজে নাও পেতে পারে। মিল দিয়ে নাম রেখে এই সমস্যার একটা সমাধান করে জাহেদা খুশি। জাহেদার স্বামী কুদ্দুসও খুশি। জাহেদুর রহমান খান নামকরণে কুদুসেরও কিঞ্চিৎ ভূমিকা আছে। নামের শেষে খান সে লাগিয়ে দিয়েছে। সে বউকে বলেছে, খান বসার কারণে নামের মধ্যে স্পিড় আসছে। আমরা খান বংশ না তো কী? আমার ছেলে খান।
কুদ্দুস ঢাকা শহরে রিকশা চালায়। তার কথাবার্তায় কিছু ইংরেজি শব্দ থাকে। এইসব ইংরেজি সে সিনেমা দেখে শিখে। সিনেমার হিয়োরা কথাবার্তায় অনেক ইংরেজি বলেন। নায়ক মান্নাভাই এক ছবিতে হিরোইনকে বললেন, চাঁদ শোন, তোমাকে খুব বিউটি লাগছে। কুদ্দুস সেখান থেকে বিউটি শব্দটা শিখেছে। ছেলের মুখ দেখে সে বলেছে, জাহেদা, তোমার ছেলে বিরাট বিউটি হয়েছে।
জাহেদা বলেছে, নজর লাগায়েন না। পিতামাতার নজর খুব খারাপ। ছেলের মাথাত থুক দেন। তিনবার বলেন, মাশাল্লা।
কুদ্দুস তার ছেলের মুখে একদলা থুথু ফেলে বলল, মাশাল্লা। তিনবার বলার কথা, সে বলল সতিবার।
সাধারণত কন্যাসন্তান সংসারে ভাগ্য নিয়ে আসে। মাওলানা সাহেব এই কথা ওয়াজে বলেছেন। জাহেদার ধারণা তার বেলায় উল্টাটা হয়েছে। ছেলে সংসারে। ভাগ্য নিয়ে এসেছে। রিকশা চালিয়ে ছেলের বাবা ভালো টাকাপয়সা আনছে। যা ভাড়া তারচেয়ে অতিরিক্ত টাকা বেশ কয়েকবার পেয়েছে। নিউমার্কেট থেকে ধানমণ্ডি তিন-এর ভাড়া হয় দশ টাকা। সেখানে এক প্যাসেনজার একশ টাকার একটা নোট বের করে বলল, ভাংতি আছে?
কুদ্দুস বলল, জি-না স্যার।
তোমার সাথে কত আছে দেখ।
কুদ্দুস টাকা গুনে বলল, একাশি টাকা আছে স্যার।
যাত্রী বলল, একাশি টাকা আমাকে দিয়ে একশ টাকার নোটটা রেখে দাও। কী আর করা।
কুদ্দুস একাশি টাকা প্যাসেনজারকে দিতে গেল। তখন হঠাৎ প্যাসেনজার বলল, থাক টাকা দিতে হবে না। পুরোটাই রেখে দাও।
এইরকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না। ছেলের ভাগ্যেই ঘটছে। কিছুই বলা যায়, ছেলের ভাগ্যেই হয়তো কুন্দুসের নিজের রিকশা হবে। মালিকের রিকশা চালিয়ে রোজ পঞ্চাশ টাকা জমা দিতে হবে না। কুদ্দুস ঠিক করে রেখেছে, নিজের রিকশা হলে সে একবেলা রিকশা চালাবে। একবেলা বিশ্রাম। সেই একবেলা সে ছেলেকে খেলা দিবে।