তিনি গাড়ির জানালার পাশে দাঁড়ালেন। একটু ঝুঁকে এলেন মেয়েটির দিকে। মেয়েটি বলল, আপনি কী চান?
তিনি বললেন, কিছু চাই না।
মেয়েটি দ্রুত জানালার কাচ তুলে দিচ্ছে। তার দৃষ্টিতে ভয়। তিনি মন খারাপ করলেন। মন খারাপ এ জন্যে না যে মেয়েটা তার না। মন খারাপ কারণ মেয়েটি ভয় পেয়েছে। ভয় পাবে কেন? তার চেহারায় কি পাগল পাগল ভাব এসে গেছে?
তিনি কালামের কাছে ফিরে এসে আরেকটা সিগারেট কিনলেন। অবাক হয়ে লক্ষ করলেন কালামের চোখেও ভীত ভাব। তার মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ির কারণে কি এটা হচ্ছে? সম্ভাবনা আছে ৷ চুলও অনেক বড় হয়েছে। পাগলদের চুল দাড়ি বড় থাকে। তারা কখনো নাপিতের কাছে যায় না।
কালাম! এখানে নাপিতের কোনো দোকান আছে? সেভ করব।
কালাম হাতের ইশারায় নাপিতের দোকান দেখিয়ে দিল। কোনো কথা বলল না।
শেভ করতে করতে তিনি কিছু সিদ্ধান্ত নিলেন।
১. মাথায় চাপ পড়ে এমন কিছু আগামী কিছুক্ষণ করবেন না। রিলাক্সেন জাতীয় ট্যাবলেট খেয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকবেন।
২. বিশ্রামের পর তিনি কোন সামাজিক অবস্থার মানুষ এটা চিন্তাভাবনা করে বের করবেন।
৩. এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে একটা রিকশা নেবেন। রিকশা হুড ফেলা থাকবে। তিনি হাতের রুমালটা এক হাতে উঁচু করে ধরে রাখবেন। যাতে সবাই তার দিকে তাকায়। চুপচাপ রিকশায় বসে থাকলে কেউ তাকাবে না। একটা হাত উঁচু করে সেই হাতে সাদা রুমাল। মোটামুটি অদ্ভুত দৃশ্য। তখন সবাই তাকাবে। এদের মধ্যে কেউ-না-কেউ বলবে–আরে কালাম! (কিংবা সালাম, কিংবা রহমত কিংবা অন্যকিছু) সমস্যা কী? কোথায় যান?
৪. পত্রিকা অফিসে গিয়ে ছবিসহ একটা বিজ্ঞাপন ছাপার কি সময় হয়েছে? ছবির নিচে কি লেখা থাকবে? কেউ কি জানেন আমি কে? এই জাতীয় কিছু।
নাপিত বলল, চুল অনেক বড় হয়েছে। চুল কেটে কলপ দিয়ে দিব?
কত লাগবে?
সব মিলায়ে দেড়শ টাকা লাগবে। বিলাতি কলপ।
আমার কাছে আছেই দুইশ টাকার মতো। এত টাকা খরচ করতে পারব না। ঘণ্টা হিসাবে রিকশা ভাড়া করব, এতেই মেলা টাকা যাবে।
একশ টাকায় করাইবেন?
তিনি হতাশ গলায় বললেন, প্রতিটি পয়সা এখন আমাকে হিসাব করে খরচ করতে হবে।
মাথা মালিশ করবেন? কুড়ি টাকা।
তিনি বললেন, মাথা মালিশ করা যায়। এতে কিছু সুবিধা হবার কথা, তবে ঘাড় মটকাবেন না। এখন বাজে কয়টা?
একটা বাজে।
আশেপাশে কোনো পার্ক আছে যেখানে শান্তিমতো ঘুমাতে পারি?
বাড়িতে গিয়া ঘুমান।
বাড়িতে গিয়ে ঘুমানোর সামান্য সমস্যা আছে।
বুঝেছি। আর বলতে হবে না। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে চলে যান। ভালো। একটা বেঞ্চি দেখে ঘুম দেন।
আপনার নাম কী?
নিবারণ।
হিন্দু?
জে হিন্দু।
তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আমি কোন ধর্মের কে জানে?
নাপিত বলল, কী কইলেন?
তিনি বললেন, কিছু বলছি না।
নাপিত চুল টানছে। ঘাড়ে থাবা দিয়ে নানান চটকাচটকি করছে। বেশ আরাম লাগছে। আরামে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমিয়েও পড়লেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলেন, তিনি ট্রাফিক কনট্রোল করছেন। তবে তার গায়ে ট্রাফিক পুলিশের পোশাক। মুখে বাঁশিও আছে। ট্রাফিকের বিরাট বিশৃঙ্খলা অবস্থা দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি করে তিনি মোটামুটি সামলে ফেলেছেন। শুধু সিগারেটওয়ালা কালামকে সামলানো যাচ্ছে না। সে একটা ট্রাক নিয়ে বের হয়েছে। ট্রাকের একটা চাকা নর্দমায় পড়ে গেছে।
স্যার, বিরাট ঘুম দিয়েছেন। এখন যান।
তিনি নাপিতের চেয়ার থেকে লজ্জিত ভঙ্গিতে নামলেন। নাপিতকে পাওনার ওপরে দশ টাকা বখশিস দিলেন। ঘুমের কারণে শরীরটা ফ্রেস লাগছে। তবে প্রচণ্ড ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। ঢাকা শহরে নিশ্চয়ই তার কোনো একটা বাসা আছে। হয় বড়লোকের বাসা, নয় সাধারণ একটা বাসা। যাই থাকুক, বাসায় পৌঁছতে পারলে সাবান ডলে গরম পানি দিয়ে একটা ভালো গোসল দিয়ে খেতে বসতেন। খাবার। পর গল্পের বই চোখের সামনে ধরে আরামের ভাতঘুম।
তিনি নাপিতের দোকান থেকে বের হয়ে একটা ফার্মেসিতে গেলেন। প্রেসার মাপালেন। প্রেসার ঠিক আছে। ওপরেরটা ১৫০ নিচেরটা ৮৫র কিছু কম। এই বয়সে পঁচাশি প্রেসার তেমন কিছু না। তিনি দুটা রিলাক্সিন কিনে ফার্মেসিতেই খেয়ে ফেললেন। নার্ভ রিলাক্সড হওয়া দরকার। এতে যদি কিছু মনে পড়ে। তার। দরকার লম্বা ঘুম। নাপিতের দোকানের তিন মিনিটের ঘুম না।
তিনি চলে গেলেন সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, বিভিন্ন বেঞ্চে অনেকেই আরাম করে ঘুমাচ্ছে। তিনি একটা খালি বেঞ্চ খুঁজে বের করলেন। আর তখনই তেরো-চৌদ্দ বছরের এক ছেলে এসে বলল, খানী খাবেন স্যার?
কী খানা?
তেহারি, সঙ্গে হাফ ডিম আছে। ত্রিশ টাকা প্লেট।
খাব।
বোতলের পানি দিব না কলের পানি? বোতলের পানি পাঁচ টাকা। তয় কলের পানি কিন্তু ভালো। নিজের হাতে কল চাইপা আনি।
কলের পানিই খাব। নাম কী তোমার?
জেমস।
জেমস মানে কি মণিমুক্তা?
জানি না। আপনি বসেন, আমি খানা নিয়া আসি। অন্যের কাছ থাইক্যা খানা নিবেন না।
আমি আপনেরে বুক করেছি।
আমি তোমার কাছ থেকেই খানা নিব। অন্যের কাছ থেকে নিব না।
বালিশ লাগবে স্যার?
বালিশ পাওয়া যায়?
পাওয়া যায়। ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া। দুই টেকা ঘণ্টা।
বালিশ নিব।
জেমস মানে যে মণিমুক্তা এটা মনে পড়ায় তিনি খুবই আনন্দ পাচ্ছেন। ইংরেজি ভাষাটা জানা আছে। তার উচিত একটা ইংরেজি পত্রিকা জোগাড় করে পড়া। পড়লেই বুঝা যেত ভাষার ওপর তার দখল কতটা। জেমস ছেলেটাকে পাঠিয়ে একটা ইংরেজি পত্রিকা কিনতে হবে।