তার কাছে একটা মানিব্যাগ কেন থাকবে না? এটা হতে পারে তিনি মানিব্যাগ গাড়িতে ফেলে এসেছেন। হয়তো তার গাড়ি আছে। গাড়ির পেছনের সিটে মানিব্যাগ এবং মোবাইল পড়ে আছে।
একটু দূরে তিন-চারটা গাড়ি পার্ক করা। এর কোনো একটা কি তার? একটা প্রায় নতুন পাজেরো গাড়ি দেখা যাচ্ছে। পাজেরো গাড়িটা কি তার? যার একটা এত বড় পাজেরো গাড়ি থাকবে সে দুইশ তেত্রিশ টাকা রাবার ব্যান্ডে বেঁধে পকেটে রেখে ঘুরবে না। তবে পয়সাওয়ালা লোকদের মধ্যে নানান একসেনট্রিসিটি থাকে। তার মধ্যেও হয়তো আছে। তিনি গাড়িগুলির দিকে এগুলেন। কোনো গাড়ির ড্রাইভার এগিয়ে এল না। তিনি পেয়ারাওয়ালার কাছে ফিরে গেলেন। নতুন পৃথিবীতে পেয়ারাওয়ালাটাকেই তার আপন মনে হচ্ছে। যদিও লোকটা নোংরা, যে পানিতে পেয়ারা ধুচ্ছে সেটা নোংরা কুচকুচে কালো। পানি। ধারালো একটা ছুরি দিয়ে কচকচ করে সে পেয়ারা কাটছে। ছুরিটা ঝকঝক করছে। খবরের কাগজের কাটা অংশে বিট লবণ মাখিয়ে পেয়ারা দিচ্ছে, সেই কাগজও নোংরা। মনে হয় রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছে।
পেয়ারা কত করে?
পাঁচ টাকা পিস।
বড়টাও পাঁচ টাকা ছোটটাও পাঁচ টাকা?
সব একর। কোনটা নিবেন বলেন কাইটা দেই।
তিনি সময় নিয়ে পেয়ারা বাছলেন, প্রধান কারণ কিছু সময় কাটানো। এর মধ্যে যদি ঝট করে সবকিছু মনে পড়ে। তাছাড়া তার মন বলছে তার এখানেই থাকা উচিত। কেউ তার খোঁজে এলে এখানেই আসবে।
বিট লবণ দিয়ে বেশ আগ্রহ করে তিনি পেয়ারা খেলেন। পেয়ারাগুলি ভালো। বাসার জন্যে কিছু নিয়ে গেলে হয়। সমস্যা একটাই–বাসা কোথায় তিনি জানেন। বাসায় কে কে আছে তাও জানেন না। তাদের চেহারা কেমন কে জানে? নিজের চেহারাও দেখতে ইচ্ছা করছে। সেটা কোনো সমস্যা না। চশমার দোকানে ঢুকে পড়েলেই হলো। চশমার দোকানে ঢোকার প্রয়োজনও আছে। হয়তো তিনি চশমার অর্ডার দিতে এসেছিলেন। তা না হলে চশমার দোকানগুলির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন? তার চশমার ফ্রেমটাও এদের দেখানো দরকার। যদি চশমার ফ্রেম দামি হয় তাহলে নিজের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে একটা ধারণা হবে। সস্তা ফ্রেম হলে এলেবেলে ধরনের কেউ। রিটায়ার্ড স্কুল টিচার।
একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। তার মানে কি এই যে, তিনি একজন স্মোকার? স্মোকার হলে পকেটে সিগারেটের প্যাকেট থাকত। মুখে সিগারেটের গন্ধ থাকত। তিনি তো পেয়ারাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন না–এই, আমার মুখটা তাঁকে দেখ তো মুখে সিগারেটের গন্ধ আছে কি-না।
তিনি চশমার দোকানে ঢুকলেন। আয়নায় নিজেকে দেখলেন। মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি দেখে অবাক হলেন। তার মানে শেভ না করেই বের হয়েছেন। তিনি কি অতি সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থার কেউ? যার প্রতিদিন শেভ করা এক ধরনের বিলাসিতা। তিনি চোখ থেকে চশমার ফ্রেম খুলে সেলসম্যানকে বললেন, ভাই, এই ফ্রেমটা একটু দেখুন তো?
কী দেখব?
ফ্রেমটা কত দামের এটা দেখবেন। ঠিক এই ধরনের আরেকটা ফ্রেম কিনব।
সাধারণ চায়নিজ ফ্রেম, দুশ আড়াইশ টাকা দাম হবে। আমাদের কাছে একই রকম দেখতে ভালো জার্মান ফ্রেম আছে। দাম সামান্য বেশি পড়বে। দেখাব?
থাক। আরেকদিন দেখব।
তিনি প্রতিটি চশমার দোকানে গেলেন। যদি কেউ তাকে দেখে বলে–স্যার আপনি! কিছু ফেলে গেছেন? যদি এরকম কিছু বলে তাহলে তিনি বলবেন–কিছু ফেলে যাই নি। অর্ডার যেটা দিয়েছি সেই অর্ডার স্লিপটা দেখব। বাসার ঠিকানা ভুল দিলাম কি-না।
চশমার দোকানের কেউ কিছু বলল না। তিনি বাইরে এসে একটা সিগারেট কিনলেন। সিগারেটের ধোঁয়ায় যদি কিছু হয়। সিগারেট ধরিয়ে আনন্দ পেলেন। তার জীবন পুরোপুরি কর্মশূন্য হয়ে যায় নি এই ভেবে আনন্দ। তার চিন্তাশক্তি যে নষ্ট হয়ে যায় নি এটাও একটা সুসংবাদ। স্মৃতিশক্তিহীন মানুষ যদি লজিকও হারিয়ে ফেলে তাহলে তাকে যা বলা হবে তা হলো পাগল। সে তখন রাস্তায় ট্রাফিক কনট্রোল করবে। পাগলরা ট্রাফিক কনট্রোল করতে অত্যন্ত ভালোবাসে। শুরুতে কাপড় গায়ে দিয়েই ট্রাফিক কনট্রোল করে, তারপর এক বিশেষ মুহূর্তে গায়ের সব কাপড় খুলে নতুন উদ্যমে ট্রাফিক কনট্রোল শুরু করে।
পাগল সম্পর্কে এই চিন্তাটা যে তার এসেছে এতে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছেন। মানুষের পরিচয় তার স্মৃতিশক্তিতে না, মানুষের পরিচয় তার চিন্তায়।
তিনি সিগারেটের দোকানির দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, ভাই আপনার নাম কী?
সিগারেটের দোকানি অবাক হয়ে বলল, আমারে জিগান?
হ্যাঁ।
নাম দিয়া কী করবেন?
এম্নি জানতে চাচ্ছি। একটা পশুর সঙ্গে আরেকটা পশুর যখন দেখা হয়, তখন তারা কিন্তু কেউ কারো নাম জানতে চায় না। মানুষ চায়।
দোকানি খানিকটা ভীত গলায় বলল, কালাম।
আপনার নাম কালাম?
জি।
ভেরি গুড। দুর্ভাগ্যের বিষয় আমি আমার নামটা আপনাকে বলতে পারছি। দুঃখিত।
দোকানি অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। তিনি সিগারেটের শেষ টান দিয়ে উৎসাহিত ভঙ্গিতে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। কালো রঙের বিশাল একটা গাড়ি এসে থেমেছে। গাড়ির পেছনের সিটে সতেরো-আঠারো বছরের যে তরুণী বসে আছে, সে হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চেহারা শ্যামলা। চোখ বড় বড়। তার নিজের চোখও বড় বড়। কিছুক্ষণ আগে চশমার দোকানে দেখেছেন। মেয়েটি তারই মেয়ে এটা মনে হয় ধরে নেয়া যায়। বাবাকে এখানে রেখে কোনো একটা কাজে গিয়েছিল, এখন ফিরে এসেছে। বাবাকে নিয়ে বাসায় যাবে।