শায়লা সবসময় বলত সে এমন একটা দেশে বাস করতে চায় যেখানে টিকটিকি নেই।
এমন দেশ কি আছে?
শীতের দেশে টিকটিকি থাকে না। আমেরিকা, ইংল্যান্ড। আমার পক্ষে তো তাকে ঐসব দেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।
জহির চোখ মুছতে মুছতে বলল, তবে এখন সে যেখানে আছে সেখানে। নিশ্চয়ই টিকটিকি নেই। স্যার যদি কিছু মনে না করেন তাহলে টিকটিকি নিয়ে
একটা অন্যায় রসিকতা শায়লার সঙ্গে করেছিলাম, সেই গল্পটা বলি?
বলুন।
আমাদের প্রথম ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে তাকে একভরি সোনার একটা টিকটিকির লকেট বানিয়ে গিফট দিয়েছিলাম। সে খুবই কান্নাকাটি করেছিল। এখন ভেবেই খারাপ লাগছে।
ওসি সাহেব টিসু পেপারের বাক্স এগিয়ে দিলেন। জহির চোখ মুছল। ওসি সাহেব বললেন, প্রশ্ন-উত্তরের ঝামেলাটা শেষ করে ফেলি। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বসে আছেন।
জহির চোখে টিসু চাপা দিয়ে হা-সূচক মাথা নাড়ল।
দুজন ঘুমুতে গেছেন তখন ঝগড়া শুরু হলো?
হুঁ।
এক পর্যায়ে আপনি নিজের শোবার ঘর ছেড়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন?
জি।
ঘুম হয়েছিল, না-কি নিঘুম রাত কেটেছে?
দুটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছি।
এক ঘুমে রাত কার?
জি।
জহির সাহেব, আপনার মোবাইল টেলিফোন আমরা চেক করেছি। দেখা গেছে আপনি সারারাতই কাউকে না কাউকে টেলিফোন করেছেন। আর আপনার ঘরেও প্রচুর সিগারেটের টুকরা পাওয়া গেছে। সর্বমোট সতেরোটা। আপনি তো সিগারেট খান না। ঐ দিন মনে হয় এক প্যাকেট সিগারেট কিনেছিলেন।
জহির জবাব দিল না। সে একদৃষ্টিতে ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। ওসি সাহেব বললেন, আপনার স্ত্রীর মামাতো ভাই সুমনকে আপনার স্ত্রী মোবাইল ফোনে একটা এসএমএস পাঠিয়েছেন। সেখানে লেখা আপনারা রাতের বাসে রওনা হচ্ছেন। এই বিষয়ে কিছু জানেন?
না।
বিভিন্ন বাস কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে যে বাস কোম্পানির টিকিট কেটেছেন সেটা আমরা বের করেছি।
টিকিট কাটলেও অফিস ছুটি দিচ্ছিল না।
আপনার টিকিট বৃহস্পতিবার রাতের। রিটার্ন টিকিট শনিবারের। অফিস শুক্র-শনিবার বন্ধ থাকে।
স্টেশন লিভ করতেও অনুমতি লাগে।
আপনার স্ত্রীর গায়ে ছিল ঝলমলে শাড়ি। মুখে মেকাপ। চোখে কাজল। যেন তিনি বেড়াতে যাবার জন্যে তৈরি। এই পোশাকে কেউ ঘুমুতে যায় না।
জহির চুপ করে থাকল।
ওসি সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, খুন আপনি করেছেন। কীভাবে করেছেন সেই বিষয়ে একটা স্টেটমেন্ট দিন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে আগেই খবর দিয়ে রেখেছি। উনি আপনার সঙ্গে থাকবেন। স্টেটমেন্ট তৈরিতে সাহায্য করবেন।
ওসি সাহেব ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। জহির চুপচাপ বসে আছে। একটা টিকটিকি টেবিলের ওপর হাঁটাহাঁটি করছে। ঘাড় কাত করে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে জহিরের দিকে।
তিনি
ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি। জুলফির চুল সব পাকা। মাথার চুলও পাকা, তবে কলপ দেবার অভ্যাস আছে। কলপের কারণে মাথার চুল কাচা মনে হচ্ছে, যদিও চুলের গোড়া সাদা হয়ে আছে। তার পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির রঙ সামান্য হলুদ। কাপড়ের রঙের ভাষায় একেই সম্ভবত অফ হোয়াইট বলে। গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে একটু লম্বা। গায়ের রঙ গৌছ। মুখমণ্ডলে চারকোণা ভাব আছে। পশ্চিমবঙ্গের ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চেহারার সঙ্গে তার চেহারার ভালো মিল আছে। তবে এই ভদ্রলোক সুনীলের মতো সুলকায় না। ভদ্রলোকের চোখে মেটালিক ফ্রেমের চশমা। চশমার কাচ তেমন ভারি না। কাচের ভেতর দিয়ে তার চোখ দেখা যাচ্ছে। চোখে ভরসা হারানো দৃষ্টি।
ভদ্রলোকের বড় ধরনের একটা সমস্যা হয়েছে। তিনি কিছুই মনে করতে পারছেন না। তিনি দাড়িয়ে আছেন এলিফ্যান্ট রোডের চশমার দোকানের সামনে। তার পাশে একটা লোক পেয়ারা বিক্রি করছে। রাস্তায় এবং ফুটপাথে প্রচুর ভিড়। খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থেকে তিনি লোক চলাচলের অসুবিধা করছেন। পেয়ারওয়ালার দিকে একটু সরে গেলেন এবং বিস্ময়ের সঙ্গে চারপাশ দেখতে লাগলেন।
মানুষের সাময়িক ব্ল্যাকআউট হয়। ব্লাভপ্রেসার বেড়ে গেলে হয়। রক্তের সুগার বা অক্সিজেন কমে গেলে হয়। কিন্তু তার হয়েছেটা কী? স্থায়ী ব্ল্যাকআউট হয়ে গেছে? তিনি তার নাম মনে করতে পারছেন না। বাসা কোথায় মনে করতে পারছেন না। এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছেন এবং কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন তাও মনে করতে পারছেন না। আতঙ্কে অস্থির হয়ে যাবার মতো ব্যাপার ঘটেছে। তবে তিনি এখনো। অস্থির হন নি। পুরো ঘটনায় বিস্ময় বোধেই অভিভূত হয়েছেন। তার চিন্তাশক্তি যে কাজ করছে এতেই তিনি খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করছেন। তার নিজেকে বুদ্ধিমান মানুষ বলে মনে হচ্ছে। একজন বুদ্ধিমান মানুষ নিজেকে খুঁজে পাবেই। তিনি পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিলেন। পকেটে মানিব্যাগ থাকবে। একটা মোবাইল টেলিফোন থাকবে। যেখান থেকে ঠিকানা বের করা তিন-চার মিনিটের ব্যাপার।
পকেটে মোবাইল নেই, মানিব্যাগও নেই। একটা রুমাল আছে। বাম পকেটে কিছু টাকা পাওয়া গেল–দুশ তেত্রিশ টাকা। টাকাটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। টাকার সঙ্গে একটা ছোট্ট কাগজে লেখা রসমালাই। তিনি কি দুইশ তেত্রিশ টাকা নিয়ে রসমালাই কিনতে বের হয়েছেন? তাহলে তো তার মিষ্টির দোকানের সামনে থাকার কথা। এখানে আশেপাশে কোনো মিষ্টির দোকান নেই। সারি সারি জুতার দোকান।