কাওরান বাজারে একটা জারুল গাছ আছে। ঐ গাছে আমাদের বাসা। গত সিডরের সময় বাসা ভেঙে গিয়েছিল। এখন রিপেয়ার করেছি।
ভালো কথা মনে পড়েছে। তোমার নাম কী? আমার মেয়ে তোমার নাম জানতে চেয়েছিল। মেয়েকে তোমার কথা বলেছি।
স্যার, আমার কোনো নাম নেই। আমাদের নাম থাকে না। আপনার মেয়েকে বলবেন সুন্দর দেখে একটা নাম দিতে।
আচ্ছা বলব।
কাক গলা নিচু করে বলল, টেলিফোন কি করেছেন স্যার?
কী টেলিফোন?
ফরিদ সাহেবকে টেলিফোন। আজ আবার তাকে বলবেন, কা কা কা। তুই গু খা।
একবার তো বলেছি। আর কেন?
রোজ একবার বলা দরকার।
অসম্ভব। তোমার কথাবার্তা শুনলে অফিসে রিপোর্ট হবে। চাকরি চলে যাবে।
টেলিফোন করতে না চাইলে করবেন না। তবে…
তবে কী?
কাক নিঃশ্বাস ফেলার মতো ভঙ্গি করে বলল, না থাক। আপনার জানার দরকার নাই।
আশরাফুদ্দিন নিতান্ত অনিচ্ছায় টেলিফোন করলেন। ফরিদ সাহেব বললেন, কে?
আশরাফুদ্দিন বললেন, স্যার আমি।
কী চান?
আশরাফুদ্দিন বললেন, কা কা কা। তুই গু খা।
এর মানে কী?
আশরাফুদ্দিন আমতা আমতা করে বললেন, স্যার, এর মানে আপনাকে গু খেতে বলছে। একটা কাক আপনাকে গু খেতে বলছে।
ফরিদ সাহেব টেলিফোন রেখে দিলেন।
বড় সাহেব আশরাফুদ্দিনকে ডেকে পাঠিয়েছেন। জরুরি কথা বলবেন।
আশরাফুদ্দিন বড় সাহেবের ঘরে এসেছেন। স্যার এখনো বসতে বলেন নি বলে বসতে পারছেন না। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। স্যারের ঘরে এসি চলছে। ঘর। ফ্রিজের ভেতরের মতো ঠান্ডা। তারপরেও আশরাফুদ্দিনের শরীর ঘামছে। প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে। বড় সাহেব ফাইল দেখছিলেন। ফাইল দেখা বন্ধ করে ঠান্ডা গলায় বললেন, আশরাফ সাহেব, আপনি না-কি রোজ গভীর রাতে টেলিফোন করে হেড ক্যাশিয়ার ফরিদ সাহেবকে গু খেতে বলেন?
আশরাফুদ্দিন কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, জি স্যার বলি।
কেন বলেন জানতে পারি?
স্যার, চেয়ারে বসে তারপর বলি? দাড়িয়ে থাকতে পারছি না।
বসুন।
আশরাফুদ্দিন বসলেন। বড় সাহেব বললেন, এখন বলুন ঘটনা কী?
স্যার, আমি যে কথাগুলি বলি সেগুলো অন্যায় কথা। ভদ্রসমাজে বলার কথা।। তারপরেও বলি, কারণ কথাগুলো বললে আমার মন শান্ত হয়।
মন শান্ত হয়?
জি স্যার। টাকা চুরির ব্যাপারে উনি অন্যায়ভাবে আমাকে ফাঁসিয়েছেন। ব্যাংকে টাকা জমা দিতে না পেরে ফিরে এসেছি। উনাকে দিলাম যেন লকারে রাখতে পারেন। উনি বললেন, লকারের চাবি তুলে আনেন নাই। আমি যেন আমার ড্রয়ারে রেখে দেই। আমি আমার ড্রয়ারে রাখলাম। উনার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে এসেছি। কারণ আমার মেয়েটার খুবই অসুখ, তাকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাব। পরের দিন ড্রয়ার খুলে দেখি টাকা নাই। স্যার, এক গ্লাস পানি খাব।
বড় সাহেব তাকে পানির বোতল এবং গ্লাস এগিয়ে দিলেন। আশরাফুদ্দিন পুরো বোতলের পানি খেয়ে ফেললেন। তাতেও তৃষ্ণা মিটল না।
আশরাফুদ্দিন বললেন, পাঁচ বছর আগে স্যার এইরকম আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল। আব্দুল জলিল নামের একজন ছিলেন আমি যে পোস্টে সেই পোস্টে। উনার চাকরি চলে যায় তিন লাখ টাকার হিসাবের গরমিলের জন্যে। স্যার, আমি নিশ্চিত ফরিদ সাহেব ঐ ঘটনায় জড়িত।
যখন তদন্ত হচ্ছিল, তখন এইসব কথা তোলেন নাই কেন?
ফরিদ স্যার সুফি মানুষ। সবাই তাকে মান্য করে। উনার কথাই সবাই বিশ্বাস করে। উনার বিষয়ে কিছু বলার সাহস হয় নাই।
বড় সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তখন সাহস হয় নাই, এখন কেন হয়েছে?
একটা কাক আমাকে সাহস দিয়েছে স্যার। সে-ই আমাকে ছড়াটা বলতে বলেছে–কা কা কা। তুই গু খা। স্যার, কাকের বিষয়টা বলব? অদ্ভুত ইতিহাস।
বড় সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, শুনি আপনার ইতিহাস।
আশরাফুদ্দিন কাক কেনা থেকে কাকের কথা বলা সবটাই বললেন। কিছুই গোপন করলেন না।
বড় সাহেব বললেন, কাকের কথা বলার বিষয়টা আপনার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। সম্ভবত আপনার সাবকনশাস মাইন্ড একটা ট্রিক প্লে করেছে। তবে ফরিদ সাহেবের বিষয়টা যেন আবার তদন্ত হয় সেটা আমি দেখব।
আমি কি চলে যাব স্যার?
হ্যাঁ চলে যান। রতিদুপুরে মানুষকে ছড়া শোনাবেন না। মন দিয়ে কাজ করুন।
পরের ছমাসে বেশ কিছু ঘটনা ঘটল। নতুন তদন্তে প্রমাণ হয়েছে ফরিদ সাহেব টাকাটা চুরি করেছেন। তার চাকরি চলে গেল। ফরিদ আহমেদ পুরো টাকাটা ফেরত দিয়েও চাকরি বাঁচাতে পারলেন না।
এখনকার কথা, পাঁচ বছর আগে জলিল আহমেদ নামে যে অ্যাসিসটেন্ট ক্যাশিয়ারের চাকরি চলে গিয়েছিল তাকে খোঁজা হচ্ছে। কোম্পানি আবার তাকে চাকরি দিতে চাচ্ছে।
আশাফুদ্দিন হেড ক্যাশিয়ার হয়েছেন। পরীবাগে কোম্পানির নিজস্ব ফ্ল্যাটে উঠেছেন। সুমির বড়মামার কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছিলেন তা ফেরত দিয়েছেন।
আশরাফুদ্দিনের সুখে থাকার কথা। তিনি মোটেই সুখে নেই! কাকটা আর আসছে না। তার মেয়ে কাকটাকে চোখের দেখাও দেখে নাই। বেচারি কাকের জন্যে নাম পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছে–কাকারু। সেই নামটা কাকটাকে বলা হয় নি।
প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে দুদিন আশরাফুদ্দিনকে কারওয়ান বাজারের জারুল গাছগুলির পাশে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা যায়। তিনি শব্দ করে ডাকেন, কাকারু! কাকারু!
লোকজন সন্দেহের চোখে তাকায়। তবে কেউ মাথা ঘামায় না। ঢাকা বিশাল শহর। বিশাল শহরে নানান কিসিমের মানুষজন থাকবে, কেউ গাছের দিকে তাকিয়ে কাকারু কাকারু ডাকবে। কেউ নেংটা হয়ে ট্রাফিক কনট্রোল করবে। এটাই স্বাভাবিক।
টিকটিকি
আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?