কাক বলল, টাকাটা ছিল কোথায়?
আমার ড্রয়ারে ছিল। ব্যাংকে জমা দিতে গিয়েছিলাম। তিনটার পরে গিয়েছি বলে জমা দিতে পারি নাই। ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম।
তালা দেয়া ছিল না?
ছিল।
চাবি আপনার কাছে?
হ্যাঁ।
আর কারো কাছেই চাবি নাই?
হেড ক্যাশিয়ার ফরিদ সাহেবের কাছে একটা চাবি আছে।
কাক বলল, টাকাটা ঐ ব্যাটা কি নিয়েছে?
আশরাফুদ্দিন বললেন, অসম্ভব। উনি ফেরেশতার মতো মানুষ। নামাজ। কালামের মধ্যে থাকেন।
ফেরেশতাও তো মাঝে মধ্যে ভুল করে।
তা অবশ্যি করে। দু একবার যে আমার এরকম মনে হয় নাই তা না। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে টেলিফোন করে জিজ্ঞাস করি। পরেই মনে হয় ছিঃ ছিঃ।
কাক বলল, ছিঃ ছিঃ ছিঃ করার কিছু নাই। এখনই টেলিফোন করুন।
এখন করব?
হুঁ। কী বলতে হবে আমি শিখিয়ে দিব।
আশরাফুদ্দিন টেলিফোন করলেন। ফরিদ সাহেবই টেলিফোন ধরলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, কে?
স্যার আমি। আশরাফুদ্দিন। ভালো আছেন স্যার?
এত রাতে! কী ব্যাপার? আমি শুয়ে পড়েছিলাম তো।
আশরাফুদ্দিন রিসিভার চাপা দিয়ে ধরে রেখে ফিসফিস করে কাকটাকে বললেন, কী বলব? স্যার তো খুব রাগ করছেন।
কাক বলল, বলুন কা কা কা। তুই গু খা।
আশরাফুদ্দিন হতাশ গলায় বললেন, এটা কী করে বলব?
কাক বলল, স্পষ্ট গলায় বলবেন।
টেলিফোনের ওপাশ থেকে বিরক্ত গলায় ফরিদ সাহেব বললেন, কী বলবেন বলুন।
আশরাফুদ্দিন বললেন, কা কা কা। তুই গু খা।
ফরিদ সাহেব বললেন, কী বললেন?
আশরাফুদ্দিন কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, স্যার, আমি বলেছি—কা কা কা। তুই গু খা।
What?
আশরাফুদ্দিন টেলিফোন রেখে দিলেন। তাঁর দুশ্চিন্তার সীমা রইল না। আগামীকাল অফিসে কী হবে কে জানে? ফরিদ সাহেব নিশ্চয়ই কমপ্লেন করবেন। বড় সাহেব তাকে ডেকে পাঠাবেন। তারপর? বদ কাকটার কথা শোনা উচিত হয় নাই। দুশ্চিন্তায় আশরাফুদ্দিনের ঘুম হলো না। মাঝে মাঝে ঝিমুনির মতো আসে, তখন বিকট সব স্বপ্ন দেখেন। একটা স্বপ্নে দশ-বারোটা কাক তাকে ঠোকর দিচ্ছে। তিনি ব্যথা পাচ্ছেন না, তবে কাতুকুতু লাগছে।
আশরাফুদ্দিন খুব ভোরে, সূর্য ওঠার আগেই, ঘুম থেকে উঠেন। আজ শেষ রাতে ঘুমিয়েছেন বলেই নয়টার দিকে ঘুম ভাঙল। ঘুম ভেঙে দেখেন, রফিক দাঁড়িয়ে আছে।
সে বলল, আপনার হইছে কী? শরীর খারাপ?
না।
স্যার, আপনের কাউয়া পালায়া গেছে। কী বুদ্ধি! নিজে নিজেই তার কাইটা পালাইছে। বদ পক্ষী।
আশরাফুদ্দিন কিছু বললেন না। রফিক বলল, অফিসে যাবেন না?
যাব।
আইজ সুমি অফিার জন্মদিন। আপনেরে সকাল সকাল অফিস থাইকা ফিরতে বলছে।
আচ্ছা।
বড়মামার বাড়িতে চইলা যাইতে বলছে।
আচ্ছা।
ভালো ডেরেস পইরা অফিসে যাইতে বলছে।
আচ্ছা।
অফিসে আশরাফুদ্দিন অত্যন্ত টেনশনে কাটালেন। সারাক্ষণ মনে হলো এই বুঝি ফরিদ সাহেব ডাকবেন। কয়েকবার তার সঙ্গে দেখাও হলো। ফরিদ সাহেব একবার শুধু বললেন, কাল রাতে কি আপনি টেলিফোন করেছিলেন? আশরাফুদ্দিন বিড়বিড় করে বললেন, ইয়েস স্যার। ফরিদ সাহেব কিছুই বললেন না। ফাইলপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আশরাফুদ্দিন মনে মনে বললেন, হে আল্লাহপাক, তোমার পাক দরবারে হাজার শুকরিয়া।
আজকের দিনটা মনে হয় আশরাফুদ্দিনের জন্যে ভালো। সুমির বড়মামার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে শুনলেন, মুনির জরুরি কাজে আজ সকালের ফ্লাইটে চিটাগাং গিয়েছেন। আগামীকাল ফিরবেন। সুমির মা মন খারাপ করে বলল, ভাইজান জন্মদিনের জন্যে এত কিছু করলেন আর নিজেই থাকতে পারলেন না।
আশরাফুদ্দিন বললেন, ভেরি স্যাড।
সুমির মা বললেন, জন্মদিন আমি একদিন পিছিয়েছি। ভাইজান আসলে হবে।
আমি কি চলে যাব?
খাওয়াদাওয়া করে যাও। মনু বাবুর্চিকে দিয়ে মোরগপোলাও রান্না করানো হয়েছে।
নিতান্তই অনিচ্ছার সঙ্গে আশরাফুদ্দিন বললেন, আচ্ছা।
রাত নটায় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আশরাফুদ্দিন মোরগপোলাও খেতে বসলেন। খাওয়ার সময় মেয়ের সঙ্গে নিচু গলায় অনেকক্ষণ কথা বললেন।
সুমি বলল, বাবা, আমার জন্যে কী কিনেছ?
কাক কিনেছি।
সত্যি?
হুঁ। কাকটা কথা বলতে পারে।
কই দেখি।
সঙ্গে আনি নাই।
বাসায় আছে?
হুঁ।
তোমার ঘরে থাকে?
হুঁ।
কাল আনবে?
দেখি আনতেও পারি।
সুমির আনন্দে ঝলমল করা চোখ-মুখ দেখে আশরাফুদ্দিনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেয়েকে মিথ্যা কথা বলেছেন–কাক নেই, চলে গেছে। এই কথাটা বলা প্রয়োজন ছিল। একটি শিশু বড় হবে সত্যের ভেতর।
কাকটার নাম কী বাবা?
নাম জিজ্ঞেস করি নাই।
আজ জিজ্ঞেস করবে।
আচ্ছা।
বাবা, তুমি খুব ভালো।
আশরাফুদ্দিনের চোখে পানি এসে গেল। এরকম একটা মেয়ে থাকলে আর কিছুই লাগে না।
আজ ঘুমুতে যেতে একটু দেরি হলো। অনেক হিসাব-নিকাশ করলেন মেয়েটার জন্যে আরেকটা কাক কেনা যায় কি-না। খাঁচার দাম লাগবে না। খাঁচা তো আছেই। তবে এই খাঁচাটা বদলে এক সাইজ বড় কেনা দরকার। যাতে কাক বেচারা ঠিকমতো বসতে পারে। ঘাড়ে ব্যথা না হয়।
স্যার কি ঘুমিয়ে পড়েছেন না-কি?
কাকের গলা। ঠোঁট ফাঁক করে হাই তোলার মতো ভঙ্গি করছে। আশরাফুদ্দিন দ্রুত মশারির ভেতর থেকে বের হলেন। কাকটা জানালায় বসে আছে। আশরাফুদ্দিনের কাছে দৃশ্যটা মোটেই অস্বাভাবিক মনে হলো না।
কাক বলল, ঐদিন আপনাকে না বলে চলে গেলাম। হঠাৎ মনটা খারাপ হলো। মেয়েটার কথা মনে হলো।
তোমার মেয়ে আছে না-কি?
এক মেয়ে। সে তার মার সঙ্গে থাকে।
কোথায় থাকে?