দরজা খুলল কাজের ছেলে রফিক। সে দাঁত বের করে বলল, বাড়িতে কেউ নাই। নাই নাই নাই।
আশরাফুদ্দিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, গেছে কোথায়? সুমির বড়মামার বাড়িতে?
হুঁ। রাইতে থাকবে।
আশরাফুদ্দিন বললেন, অসুবিধা নাই। থাকুক। ঐ বাড়ির সব ঘরে এসি। সুমি আরাম করে ঘুমাবে।
আপনার হাতে এইটা কী? কাউয়া না?
হুঁ।
কাউয়া দিয়া কী করবেন?
এমনি আনলাম। সুমি খেলবে।
ঠোকর দিবে তো।
ঠোকর দিলে দিবে। একটা শিশুর নানান ঠোকর খেয়ে বড় হওয়া দরকার। তুমি কাকটার জন্যে পানি দাও। আর কিছু খাবার।
রফিক বলল, কাউয়ার খানা কই পামু কন! কাউয়া খায় আবর্জনা।
ভাত আছে না? ভাত দাও। আর আমাকে এক কাপ চা দাও।
আশরাফুদ্দিন কাক নিয়ে তার ঘরে ঢুকে গেলেন। তিনি পশ্চিমের ঘরটায় থাকেন। সুমি তার যার সঙ্গে শোবার ঘরে ঘুমায়।
আশরাফুদ্দিন রাতের খাবার খেলেন। আয়োজন ভালো না, তবে তৃপ্তি করে খেলেন। অনেক দিন পর আরাম করে টিভি দেখলেন। একটা হাসির নাটক। তিন বন্ধুর কীর্তিকলাপ। তিন বন্ধুর একজন মহানোকা। বোকাটার কাণ্ড দেখে আশরাফুদ্দিন শব্দ করে হাসলেন। সুমির মা থাকলে তিনি শব্দ করে হাসেন না। সে যে রাগ করে তা না। তারপরও কেন যেন হাসি আসে না।
আশরাফুদ্দিনের স্বভাব, গরমেও মশারি খাটিয়ে ঘুমানো। মশারি না টাঙালে তার নাকি নেংটা নেংটা লাগে। সুমির মা আবার মশারির ভেতর ঘুমাতে পারে না। তার দম বন্ধ লাগে। তাদের শোবার ব্যবস্থা এই কারণেই আলাদা। আশরাফুদ্দিন মশারির ভেতর ঢুকতে যাচ্ছেন, ঠিক তখন খাঁচার ভেতরের কাকটা ছটফট করে ডানা ঝাপ্টালো। এবং পরিষ্কার মানুষের গলায় বলল, হ্যালো স্যার। ঘুমিয়ে পড়লেন না-কি?
আশরাফুদ্দিনের মনে হলো তিনি ভুল শুনেছেন। এরকম ভুল মানুষের মাঝে মধ্যে হয়। আশেপাশে কেউ নেই, তারপরেও মনে হয় কেউ-একজন কথা বলেছে। আশরাফুদ্দিন ভীত গলায় বললেন, কে? কে কথা বলে?
কাকটা বলল, স্যার আমি। আপনার কাজের ছেলেটা আমাকে পানি দেয় নাই। তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছি। কোনো খাবারও দেয় নাই। সে যে বলেছে আমরা আবর্জনা খাই এটা ঠিক না। খাবার পাই না বলে আবর্জনা খাই। শখ করে আবর্জনা কেন খাব?
আশরাফুদ্দিন কাঁপা গলায় বললেন, তুমি কি সত্যি সত্যি কথা বলছ?
জি স্যার। কথা বলার ইচ্ছা ছিল না। বিপদে পড়ে বললাম। তৃষ্ণায় জান। যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সব কাকই কি কথা বলতে পারে?
কাক বলল, স্যার আগে পানি খাওয়ান, তারপর অন্য আলাপ।
আশরাফুদ্দিন পানি আনলেন। টেবিলে ভাত ঢাকা দেয়া ছিল। ভাত আনলেন। একটা কলা অনলেন। এবং সারাক্ষণই মনে মনে বললেন, কোনো কারণে ধান্দা লেগে গেছে বলে এরকম মনে হচ্ছে। কাক কেন কথা বলবে? হযরত সোলায়মান আলায়েস সালাম পশুপাখির কথা বুঝতেন। তিনি তো সোলায়মান নবী না।
খাঁচার ভেতর রাখা কনডেন্সড মিল্কের খালি কৌটায় পানি ঢালা হলো। কাকটা ঠোঁট ডুবিয়ে ডুবিয়ে অনেকক্ষণ পানি খেল। একসময় আশরাফুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, সত্তর টাকা দিয়ে এমন এক খাঁচা কিনেছেন, মাথা উঁচা করে বসতেও পারতেছি না। একশ টাকার খাঁচা একটা কিনলে আরাম করে বসতে পারতাম। ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে।
খাঁচা খুলে দেই?
কাক বলল, দেন। আর কলাটা ছিলে দেন।
আশরাফুদ্দিন খাঁচা খুলে দিলেন। কাক খাঁচা থেকে বের হয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে মেঝেতে কিছুক্ষণ হাঁটল। ডানা ঝাপ্টালো। আশরাফুদ্দিন বিড়বিড় করে বললেন, মনে হয় আমার মাথায় কোনো গণ্ডগোল হয়েছে।
কাক বলল, অসম্ভব কিছু না। গরম পড়েছে মারাত্মক। গরমের কষ্ট এবং নানাবিধ চিন্তায় মাথায় গণ্ডগোল হওয়া স্বাভাবিক। আপনাদের ডাক্তার কবিরাজ কত কিছু আছে। আমাদের কিছুই নাই।
আশরাফুদ্দিন বললেন, মানুষের মতো কথা কি তুমি একাই বলতে পার, নাকি
অন্য কাকরাও পারে?
কাক কলা খেতে খেতে বলল, আমরা সবাই পারি। আমরা সবসময় থাকি মানুষের কাছাকাছি। ওদের ভাষা শিখব না?
তাহলে অন্যরা কথা বলে না কেন?
কাক বলল, সব কাক কথা বলা শুরু করলে উপায় আছে? কা কা বলে দুবার ডাকলেই আপনারা বলেন, গৃহস্থের অমঙ্গল। সেখানে যদি কথা বলা শুরু করি…। বাজে আলাপ বন্ধ থাকুক, আপনার মেয়ে কই? যার জন্যে আমাকে কিনেছেন,
তাকে তো এখনো দেখলাম না।
সে তার বড়মামার বাড়িতে। জন্মদিনের অনুষ্ঠান সেই বাড়িতেই হবে।
আপনি কি সেখানে আমাকে নিয়ে যাবেন?
আশরাফুদ্দিন বললেন, কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কী বলে?
কাক নিয়ে উপস্থিত হওয়া ঠিক হবে না। কাককে আপনারা বলেন অশুভ। জন্মদিন একটা শুভ অনুষ্ঠান।
ঠিক বলেছ। সুমির বড়মামা সবার সামনে আমাকে পাগল-টাগল বলে বসতে পারে। হঠাৎ বড়লোক হয়েছে তো, আমাকে খুবই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। এমন লজ্জা পাই। সেদিন একগাদা লোকের সামনে বলল, আপনি অপদার্থের শিরোমণি।
কাক বলল, শিরোমণি কী জিনিস?
শিরোমণি মানে সেরা। আমি না-কি অপদার্থের সেরা।
কাক বলল, মুখের উপর বলে দেন–
কা কা কা
তুই গু খা।
আশরাফুদ্দিন বললেন, ছিঃ ছিঃ, এইসব কথা কীভাবে বলি? আমার স্ত্রীর বড় ভাই। বিপদে আপদে সাহায্য করে।
কী সাহায্য করে?
তার কারণে জেলের হাত থেকে বেঁচেছি। বিরাট ইতিহাস, শুনবে?
মানুষের ইতিহাস শুনে আমার লাভ কী। ঠিক আছে বলতে চাচ্ছেন বলুন।
আশরাফুদ্দিন আগ্রহ নিয়ে অফিসে টাকা-পয়সার গণ্ডগোলের গল্প শুরু করলেন। কাকটাকে দেখে মনে হচ্ছে সেও খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে। মাঝে মাঝে বলছে। মাথা নাড়ছে। আশরাফুদ্দিনের মনে হলো এত আগ্রহ নিয়ে এর আগে। কেউ তার দুঃখের গল্প শোনে নি।