বাসায় ফেরার সময় আশরাফুদ্দিন চেষ্টা করেন মেয়ের জন্যে কিছু কিনতে। লজেন্স, বাদাম, আইসক্রিম।
সুমির পছন্দ হাওয়াই মিঠাই। দশ টাকা দাম। আশরাফুদ্দিনের সামর্থ্যের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু হাওয়াই মিঠাই কেনা যাবে না। কারণ সুমির বড়মামা বলেছেন–এইসব জিনিস কখনো খাওয়ানো যাবে না। বাচ্চাদের পেট খারাপ হয়।
আশরাফুদ্দিনের সংসার সুমির বড় মামা মুনিরের নির্দেশেই চলে। তার কারণও আছে। আশরাফুদ্দিন তেরোশ স্কয়ার ফিটের যে ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন তা মুনিরের। আশরাফুদিন বিনা ভাড়ায় থাকছে। শুধু ইউলিটির চার্জ দিচ্ছেন। বিপদে-আপদেও মুনিরকে পাওয়া যায়।
একবার অফিসে ক্যাশে বিরাট গরমিল ধরা পড়ল। পাঁচ লাখ ছাব্বিশ হাজার টাকা ড্রয়ার থেকে গায়েব। দায়িত্ব এসে পড়ল আশরাফুদ্দিনের কাঁধে। অফিসের এম ডি হারুন সাহেব তাকে ডেকে বললেন, আপনি অনেকদিন এই অফিসে কাজ করছেন। আপনাকে আমরা একজন অনেস্ট এবং সিনসিয়ার কর্মচারী হিসেবে জানি বলেই কোনো পুলিশ কেইস করছি না। আপনাকে আমরা সাতদিন সময় দিলাম। এর মধ্যে টাকাটা জমা দিয়ে দেবেন। আমরা কোনো প্রশ্ন করব না। ধরে নেব কোনো কিছুই ঘটে নি। আগে যেভাবে কাজ করতেন সেভাবেই কাজ করবেন।
হতভম্ভ আশরাফুদ্দিন বললেন, টাকা কোথায় পাব স্যার?
হারুন সাহেব বললেন, আপনি টাকা কোথায় পাবেন আপনি জানেন। টাকা ছিল আপনার Custody-তে। সব দায়-দায়িত্ব আপনার। সাতদিন অনেক সময়। আমি নিশ্চিত এই সাতদিনে কোনো একটা ব্যবস্থা হবে। যদি না হয় তাহলে পুলিশের কাছে যাওয়া ছাড়া আমাদের হাতে অন্য অপশন নেই। যদিও আমি চাই
আমাদের অফিসের কেউ জেল খাটুক।
টাকার জোগাড় সাতদিনেই হলো। সুমির বড় মামা গম্ভীর মুখে টাকাটা দিলেন এবং বললেন, আপনি বিরাট ক্যালাস মানুষ। বোকা এবং ক্যালসি। আপনার সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় আমার বোনের জীবনটা নষ্ট হয়েছে। আপনি শুধু যে অপদার্থ তা-না, অপদার্থদের অপদার্থ। …
আশরাফুদ্দিন মুখ হাসি হাসি রাখার চেষ্টা করতে করতে সব কথা শুনলেন। মুখ হাসি হাসি রাখাটা ঠিক হয় নি। সুমির বড়মামা এক পর্যায়ে বললেন, আপনি হাসছেন কী মনে করে জানতে পারি? রং তামাশার কোনো ব্যাপার কি ঘটেছে?
বড় মানুষদের কোনো কথা ধরতে নেই। সেই বড় মানুষ যদি আত্মীয় হন তাহলে তো আরো না। আশরাফুদ্দিন সুমির বড়মামার কোনো কথা ধরেন না। কোনো অপমান গায়ে মাখেন না। শুধু যখন বাসায় ফিরে শোনেন সুমির বড়মামা এসে সুমিকে নিয়ে গেছে, আজ সুমি মামার বাসায় থাকবে, তখন বড় খারাপ লাগে। দুঃখে কাঁদতে ইচ্ছা করে।
সুমির জন্মদিন নিয়ে আশরাফুদ্দিন ভালো দুশ্চিন্তায় আছেন। তিনি উড়া উড়া শুনছেন, জন্মদিন পালন করা হবে সুমির বড়মামার উত্তরার বাড়িতে। (ডুপলেক্স বাড়ি। বারান্দা থেকে লেক দেখা যায়। সুমি ঐ বাড়িতে যেতে খুবই পছন্দ করে।) সত্যি সত্যি যদি উত্তরার বাড়িতে জন্মদিন হয় তাহলে সেখানে তাকে অবশ্যই যেতে হবে, তবে জন্মদিনের উপহার কাক নিয়ে যেতে পারবেন না। কাক দেখলে অনেক আজেবাজে কথা সুমির মামা বলে বসতে পারেন। একটা উপহার কিনে দিতে না পারা দুঃখের ব্যাপার।
কাটাবনের পাখির দোকানের মালিক বলল, কাক কিনতে চান?
জি।
কাক? কাউয়া?
জি কাউয়া।
কাউয়া দিয়ে করবেন কী?
জন্মদিনে উপহার দিব।
উপহার কাউয়া দিবেন কেন? লাভ বার্ড নিয়ে যান। জোড়া তিনশ টাকা। খাঁচা ফ্রি।
আমার কাউয়াই দরকার।
আমরা কাউয়া বেচি না।
বেচেন না কেন?
কাউয়া পাখির মধ্যে পড়ে না।
পাখির মধ্যে পড়বে না কেন? কাক তো উড়তে পারে। কা কা করে গানও গায়।
আপনি অন্য দোকানে যান। কাক কিনে কাকের গান শুনুন।
আশরাফুদ্দিন কোথাও কাক পেলেন না। শুধু এক দোকানি বলল, তারা কাক এনে দেবে, তবে এক হাজার টাকা খরচ লাগবে। পাঁচশ টাকা অ্যাডভান্স।
কাকের দাম এক হাজার টাকা?
দোকানি গম্ভীর গলায় বলল, জি, এক হাজার। কাক ধরা কঠিন ব্যাপার। কাক ধরতে গিয়ে ঠোকর খেয়ে মানুষ মারা গেছে, এটা জানেন?
আশরাফুদ্দিন বললেন, পাঁচশ টাকা পর্যন্ত দিতে পারব। এর বেশি পারব না। ভাই, আমি গরিব মানুষ।
দোকানি বলল, আগামীকাল আসেন। দেখি কাক জোগাড় করতে পারি কি না। তবে কথা দিতে পারব না। পাঁচশ টাকা দিয়ে যান। কাক না পাওয়া গেলে ফেরত নিবেন।
আশরাফুদ্দিন পাঁচশ টাকা জমা দিলেন। তার জন্যে অনেকগুলি টাকা। তা হোক, মেয়েটা খুশি হবে। মেয়ের খুশির কাছে এই টাকা সামান্য। পাঁচশ টাকা জমা দিয়ে সামান্য দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। কাক পাওয়া না গেলে টাকাটা কি ফেরত পাওয়া যাবে? টাকা আদায় করা খুব কষ্ট।
শেষ পর্যন্ত কাক পাওয়া গেল। দাম পড়ল পাঁচশ সত্তর। পাঁচশ টাকা কাকের দাম, সত্তর টাকা খাঁচার দাম। দোকানি বলল, ভালো জিনিস পাইছেন অল্প পয়সায়।
আশরাফুদ্দিনের কাছেও মনে হলো তিনি ভালো জিনিস পেয়েছেন। স্বাস্থ্যবান কাক। গায়ের পালক চকচক করছে। চোখ ঘন লাল। কাকের চোখ এমন লাল হয় তিনি জানতেন না। এত কাছ থেকে এর আগে তিনি কাক দেখেনও নি। এই বিশেষ পাখিটা মানুষের আশেপাশেই থাকে, তবে কখনোই খুব কাছে আসে না।
আশরাফুদ্দিন তার ফ্ল্যাট বাড়ির কলিং বেল টিপলেন ভয়ে ভয়ে। সুমির মা দরজা খুলে কাক দেখে কী বলবে কে জানে! হৈচৈ যে করবে বলাই বাহুল্য। তৎক্ষণাৎ কাক ছাদে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসতেও পারে। মেয়েদের কাছে কাক অমঙ্গুলে পাখি।