নভেম্বর মাস। এর মধ্যে আলাউদ্দিন বেকসুর খালাস পেয়েছে। নুরুল হক সাহেবের এক নাতি হয়েছে। নাতির নাম রূপম। নুরুল হক সাহেব যতক্ষণ বাসায় থাকেন নাতিকে কোলে রাখেন। নায়লা দূর থেকে লক্ষ করেছে তার বাবা এক মাস বয়েসি নাতির সঙ্গে বিড়বিড় করে মামলা-মোকদ্দমার গল্প করেন।
জীবনে সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা কী জানো দাদু? যখন ফাঁসি হতে যাচ্ছে এমন একজন লোক নির্দোষ প্রমাণিত হয়। খালাস পেয়ে বাড়িতে চলে যায়। আমার জীবনে কয়েকবার এরকম ঘটনা ঘটেছে। বড় হও। বড় হলে শুনবে। এখন দাদু একটু হাস তো।
এক শুক্রবার সকালে নুরুল হকের সঙ্গে দেখা করতে এল আলাউদ্দিন। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। সঙ্গে একটা বড় কাতল মাছ। জীবন্ত। কানকো নড়ছে।
স্যার, আমাকে চিনেছেন? আমি আলাউদ্দিন।
চিনেছি।
স্যারের নাতি হয়েছে শুনেছি। অতি আনন্দের সংবাদ। নাম কী রেখেছেন?
রূপম।
বাহ্ নামও মাশাল্লা সুন্দর।
মিষ্টি-মাছ এইসব আমি রাখব না। কিছু মনে করো না।
আপনি রাখবেন না জানি, তারপরেও নিয়ে এসেছিলাম। চিন্তা করবেন না স্যার। ফিরত নিয়ে যাব।
তুমি আজকাল করছ কী?
আলাউদ্দিন গলা নামিয়ে বলল, রেস্টে আছি। দশ লাখ টাকা লুকানো ছিল, এইটাই খরচ করতেছি।
নুরুল হক হতভম্ব হয়ে তাকালেন।
আলাউদ্দিন বলল, নতুন এক জোড়া জুতা আমিই রেখে দিয়েছিলাম। পুলিশ যখন আলামত হিসাবে জুতা জব্দ করেছে, তখনি বুঝেছি মামলা ডিসমিস। হা হা হা। খুন আমিই করেছি। আপনার মত ঝানু লোক ধোঁকা খেয়েছেন। এইটাই আনন্দের।
কাকারু
আশরাফুদ্দিন কাঁটাবনে পাখির দোকানে গিয়েছেন কাক কিনতে। তার মেয়ে সুমির জন্মদিনে তিনি একটা কাক উপহার দিবেন। সুমির আগামী বুধবারে দুবছর পূর্ণ হবে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা হবে শুক্রবারে। বুধবারে আত্মীয়স্বজনদের অফিস-কাচারি আছে। শুক্রবার ছুটির দিন। সবাই আসতে পারবে।
সুমির প্রথম জন্মদিনটা করা হয় নি। বেচারির হয়ে গেল নিউমোনিয়া। যমে মানুষে টানাটানি এমন অবস্থা। এক পর্যায়ে শিশু হাসপাতালের ডাক্তার বলে বসলেন, অবস্থা তেমন ভালো মনে হচ্ছে না। তবে ঘাবড়াবার মতো তেমন কিছু হয় নি। নিউ জেনারেশন ড্রাগ পড়েছে। ইনশাআল্লাহ রেসপন্স করবে। সবই আল্লাহর হাতে।
ডাক্তার যখন বলেন, সবই আল্লাহর হাতে, তখন কলিজা নড়ে যায়। আশরাফুদ্দিনের কলিজা নড়ে গেল। তিনি অদ্ভুত অদ্ভুত সব মানত করলেন। যেমন, মেয়ে যদি বেঁচে যায় বাকি জীবনে তিনি ভাত খাবেন না। রুটি খাবেন। ভাত তার অতি পছন্দের খাদ্য। তিনি সকালের নাস্তাতেও ভাত খান। মেয়ের জন্যে অতি পছন্দের খাবার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা।
তার দ্বিতীয় মানত হলো, পান খাবেন জর্দা ছাড়া।
তৃতীয় মানত, বাকি জীবন বালিশ ছাড়া ঘুমাবেন।
সুমির বয়স দুবছর হতে চলেছে। তিনি প্রতিটি মানত মেনে চলছেন। বাকি জীবন মেনে চলবেন–এই তার প্রতিজ্ঞা। তিনি তার মেয়ের কোনো অমঙ্গল চান না।
আশরাফুদ্দিনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের পেছনে একটা ঘটনা থাকে। জন্মদিনে কাক উপহার দেবার পেছনেও একটা ঘটনা আছে। ঘটনাটা এরকম–
হাসপাতাল থেকে সুমিকে ছেড়েছে। তিনি মেয়েকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় এসেছেন। বারান্দার রেলিং-এ তিন-চারটা কাক বসেছিল। সুমি হঠাৎ কাকগুলির দিকে আঙুল তুলে পরিষ্কার গলায় বলল, কাক। সুমির প্রথম শব্দ উচ্চারণ। সব শিশুই মা, বাবা, দুদু এইসব বলতে শিখে। সুমি শিখল কাক। সুমির মা নতুন শব্দ শেখানোর অনেক চেষ্টা করল–মা, বলো বাবা। বলো বাবা।
সুমি বলল, কাক।
তুমি কত লক্ষ্মীমেয়ে। তুমি সব কথা বলতে পার। বলো তো মা–পানি।
সুমি গম্ভীর গলায় বলল, কাক।
এখন অবশ্যি সুমি সব কথা বলতে পারে। কঠিন কঠিন শব্দও বলে। যেমন, কিছুদিন আগে সে তার বাবাকে বলল, বাবা, তুমি অত্যধিক গরিব।
অত্যধিক শব্দটা নিশ্চয়ই কারো কাছ থেকে শুনে শিখেছে। মেয়ের আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি, যা শুনছে সবই শিখে ফেলছে। সুমির কথাবার্তা আশরাফুদ্দিনের এত ভালো লাগে! এক-একবার আনন্দে চোখে পানি এসে যায়। মেয়েটির প্রতি অতিরিক্ত মমতা যখনি তৈরি হয় তখনি তিনি মেয়ের গায়ে হালকা করে থুতু দেন। এতে ভালোবাসার নজর কাটা যায়। পিতামাতার নজর বড় কঠিন জিনিস। ব্যাপারটা পরীক্ষিত। গত শীতের সময় চারদিকে জ্বরজারি হচ্ছে। সুমি দিব্যি সুস্থ। একদিন তিনি বললেন, বাহ, আমার মেয়েটার শরীর স্বাস্থ্য তো ভালো যাচ্ছে। সুমির মা বললেন, এইসব কী কথা! তুমি দেখি মেয়েটাকে নজর লাগবে। বলল মাশাল্লাহ। তিনি বললেন, মাশাল্লাহ। এতে লাভ হলো না–সেদিন সন্ধ্যা থেকেই সুমির জ্বর। বেচারি এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগল।
আশরাফুদ্দিন কাজ করেন একটা বড় ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে। ছোট চাকরি, অ্যাসিসটেন্ট ক্যাশিয়ার। অফিস ছুটি হয় পাঁচটায়, রোজই তার অফিস থেকে বের হতে দেরি হয়। হিসাব মিলছে না, লেজার বুকে গণ্ডগোল। প্রতিদিনই কিছু ঝামেলা থাকে। অফিস থেকে বের হতে রোজই ছটা সাড়ে ছটা, কোনোদিন সাতটাও বেজে যায়। অফিস ছুটি হওয়ার পর থেকেই তার মনটা পড়ে থাকে মেয়ের কাছে। যখন বাসার দিকে রওনা হন তখন সারাপথ চিন্তা করতে করতে যান–আজ সুমির সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলবেন। সুমিকে রোজ একটা ভূতের গল্পও শোনাতে হয়। সেই গল্পও চিন্তাভাবনা করে বের করতে হয়। একই গল্প যদি কয়েক দিন পরে আবারো বলেন, সুমি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে। মেয়ের এমন বুদ্ধি– মাশাল্লাহ!