শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। কুদূসের শরীর কাঁপছে। লিফট কি এত দ্রুত ওঠে? এ তো মনে হচ্ছে বাড়িঘর ফুড়ে আসমানে উঠে যাবে। এত দ্রুত লিফট উঠছে যে কদ্দসের পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠছে। যে ভাবে উঠছে তাতে ১০০ তলা ছাড়িয়ে যাবার কথা। এটা মাত্র বার তলা বিল্ডিং। কুদ্দুস আসহাবে কাহাফের আটটা নাম মনে করার চেষ্টা করছে। এদের নাম পড়ে বুকে ফুঁ দিলে মহা বিপদ দূর হয়। বহু পরীক্ষিত। এরা আটজন দাকিয়ানুস বাদশাহর সময়ে পর্বতের গুহায় ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রোজ কেয়ামত পর্যন্ত এরা ঘুমন্ত থাকবে। এদের সাতজন মানুষ, একটা কুকুর। সাতজন মানুষের নাম মনে পড়ছে, কুকুরটার নাম মনে পড়ছে না।
মাকসেলাইনিয়া
মাসলিনিয়া
ইয়ামলিখা
মারনুশ
দাবারনুশ
শয়নুশ
কাফশাতোইউশ
কুকুরটার নাম কি?
কুকুরের নাম মনে করতে না পারলে কোন লাভ হবে না। কুকুরের নামশুদ্ধ পড়ে বুকে ফুঁ দিতে হয়। কুদ্দস প্রাণপণে কুকুরটার নাম মনে করার চেষ্টা করছে। চরম বিপদে কিছুই মনে পড়েনা।
শোঁ শোঁ শব্দ বাড়ছেই। শব্দটা এখন কানের পর্দার ভেতরে হচ্ছে। কুদ্দুসের মুখ শুকিয়ে গেছে। সে লিফটের মেঝেতে বসে পড়ল। আর তখনই কুকুরটার নাম মনে পড়ল–কিতমীর!
কিতমীর নাম পড়ার পরপরই হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে লিফট থেমে গেল। লিফটের দরজা খুলতে শুরু করল। দরজা পুরোপুরি খোলার জন্যে কুদ্দুস অপেক্ষা করল না। সে বসা অবস্থা থেকেই ব্যাঙের মত লাফ দিয়ে বের হয়ে পড়ল। বের হয়েই হতভম্ব হয়ে গেল। সে কোথায় এসেছে? ব্যাপারটা কি? লিফট থেকে বের হওয়াটা বিরাট বোকামি হয়েছে। যে ভাবে লাফ দিয়ে সে লিফট থেকে বের হয়েছে তার উচিত ঠিক একইভাবে লাফ দিয়ে আবার লিফটে ঢুকে যাওয়া। সে পেছনে তাকালো। পেছনে লিফট নেই। লিফট কেন কোন কিছুই নেই, চারদিকে ভয়াবহ শূন্যতা। সে নিজেও বসে আছে শূন্যের উপর। মাথার উপর আকাশ থাকার কথা। আকাশ-ফাঁকাশ কিচ্ছু নেই। তার চারপাশে কুয়াশার মত হালকা ধোয়া। সেই ধোয়ার রঙ ঈষৎ গোলাপী। কুদ্দুস মনে মনে বলল, ইয়া গাফুরুর রাহিম! এ কি বিপদে পড়লাম! ও আল্লাপাক, আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার কর। হে গাফুরুর রাহিম! একবার যদি এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাই তাহলে শুক্রবারে তারা মসজিদে সিন্নি দেব। এবং বাকি জীবনে আর লিফটে চড়ব না। দরকার হলে ৫০০ তলা পর্যন্ত হেঁটে উঠব। আমার উপর দয়া কর আল্লাহপাক।
কুদ্দুস চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সে তিনবার কুলহুআল্লাহ পড়ে বুকে ফুঁ দেবে। তারপর চোখ খুলবে। তাতে যদি কিছু হয়। কোন দোয়াই প্রথম চোটে মনে পড়ছে না। হায়, এ কেমন বিপদ!
২.
কুদ্দুস চোখ খুলল। অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আগে চারপাশে ছিল গোলাপী রঙের ধোয়া, এখন বেগুনী ধোয়া। আগে কোন শব্দ ছিল না। এখন একটু পর পর সাপের শিসের মত তীব্র শব্দ হচ্ছে। শব্দটা শরীরের ভেতর ঢুকে কলজে কাপিয়ে দিচ্ছে। এরচে তো আগেই ভাল ছিল। কুদ্দুস ভেবে পাচ্ছে না সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলবে কি না। চোখ বন্ধ রাখা আর খোলা রাখা তো একই ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে সে মারা গেছে? হার্টফেল করে লিফটের ভেতরেই তার মৃত্যু হয়েছে? সে যে জগতে আছে সেটা আর কিছুই না, মৃত্যুর পরের জগৎ। এ রকম তো হয়। কিছু বোঝার আগেই কত মানুষ মারা যায়। সেও মারা গেছে, মৃত্যুর পর তাকে আবার জিন্দা করা হয়েছে। কিছুক্ষণের ভিতর মানকের-নেকের আসবে, তাকে সোয়াল-জোয়ার শুরু করবে–তোমার ধর্ম কি? তোমার নবী কে? এইসব জিজ্ঞেস করবে। এ কি বিপদ!
তুমি কে?
কুদ্দুস চমকে চারদিকে তাকালো, কাউকে সে দেখতে পেল না। প্রশ্নটা সে পরিষ্কার শুনলো। তাকেই যে প্রশ্ন করা হচ্ছে তাও বোঝা যাচ্ছে। কেমন গম্ভীর ভারি গলা। শুনলেই ভয় লাগে।
এই, তুমি কে?
কুদ্দুস কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, স্যার, আমার নাম কুদ্দুস।
তুমি এখানে কি ভাবে এসেছ?
স্যার, আমি কিছুই জানি না। লিফটের ভিতরে ছিলাম। লাফ দিয়ে বের হয়েছি। বাইর হওয়া উচিত হয় নাই। আপনে স্যার এখন একটা ব্যবস্থা করেন। গরীবের একটা রিকোয়েস্ট।
আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি এখানে এলে কি করে?
স্যার, আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করে দেন। কোথায় আসছি নিজেও জানি। কিভাবে আসছি তাও জানি না। লিফটের দরজা ভালমত খোলার আগেই লাফ দিয়েছিলাম। এটা স্যার অন্যায় হয়েছে। আর কোনদিন করব না। সত্যি কথা বলতে কি–আর কোনদিন লিফটেও চড়ব না। এখন স্যার ফেরত পাঠাবার একটা ব্যবস্থা। করেন। আমি খাস দিলে আল্লাপাকের কাছে আপনার জন্যে দোয়া করব।
তোমার কোন কিছুই তো আমরা বুঝতে পারছি না। প্রথম কথা হল–মাত্রা। কি করে ভাঙলে? মাত্রা ভেঙে এখানে এলে কি ভাবে?
স্যার বিশ্বাস করেন, আমি কোন কিছুই ভাঙি নাই। যদি কিছু ভেঙে থাকে। আপনাআপনি ভাঙছে। তার জন্যে স্যার আমি ক্ষমা চাই। যদি বলেন, পায়ে ধরব। কোন অসুবিধা নাই।
তুমি তো বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছ। তুমি কি বুঝতে পারছ ব্যাপারটা কি ঘটেছে?
জ্বি না।
তুমি ত্রিমাত্রিক জগৎ থেকে চতুর্মাত্রিক জগতে প্রবেশ করেছ। এই কাণ্ডটা কি ভাবে করেছ আমরা জানি না। আমরা জানার চেষ্টা করছি।
স্যার, ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব।
তোমার কথাবার্তাও তো আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। গোলাম হয়ে থাকব মানে কি?