স্যার, আজ এই পর্যন্ত থাক। কাল আবার নতুন করে শুরু করব।
আচ্ছা।
অফিস থেকে বেরুবার আগে জিএম সাহেব শওকত সাহেবকে ডেকে পাঠালেন। শওকত সাহেবের বুক কেঁপে উঠল। জিএম সাহেবকে তিনি কম্পিউটারের মতই ভয় পান। যদিও ভদ্রলোক অত্যন্ত মিষ্টভাষী। হাসিমুখ ছাড়া কথাই বলতে পারেন না। জিএম সাহেবের ঘরে ঢুকতেই তিনি হাসিমুখে বললেন, কেমন আছেন শওকত সাহেব?
জি স্যার, ভাল।
বসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
শওকত সাহেব বসলেন। তার বুক কাঁপছে, পানির পিপাসা পেয়ে গেছে।
আপনার কি শরীর খারাপ? জি না স্যার।
দেখে অবশ্যি মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। যাই হোক, কম্পিউটার শেখার কতদূর হল?
শওকত সাহেব কিছু বললেন না। মাথা নিচু করে বসে রইলেন। জিএম সাহেব বললেন, আমি সাজেদুল করিমকে গতকাল কঠিন বকা দিয়েছি। তাকে বলেছি–তুমি কেমন ছেলে, সামান্য একটা জিনিশ শওকত সাহেবকে শেখাতে পারছ না?
তার দোষ নেই স্যার। সে চেষ্টার ত্রুটি করছে না। আসলে আমি শিখতে পারছি না।
পারছেন না কেন?
বুঝতে পারছি না স্যার।
কম্পিউটার তো আজ ছেলেখেলা। সাত-আট বছরের বাচ্চারা কম্পিউটার দিয়ে খেলছে। আপনি পারবেন না কেন? আপনাকে তো পারতেই হবে। পুরানো দিনের মত কাগজে-কলমে বসে বসে হিসাব করবেন আর মুখে বিড়বিড় করবেন–হাতে আছে পাচ, তা তো হবে না। আমাদের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। যা হবে সব কম্পিউটারে হবে।
জ্বি স্যার।
নতুন টেকনোলজি যারা নিতে পারবে না তাদের তো আমাদের প্রয়েজন। নেই। ডারউইনের সেই থিয়েরি–সারভাইল ফর দি ফিটেস্ট। বুঝতে পারছেন?
জ্বি স্যার।
আচ্ছা আজ যান। চেষ্টা করুন ব্যাপারটা শিখে নিতে। এটা এমন কিছু না। আপনার নিজের ভেতরও শেখার চেষ্টা থাকতে হবে। আপনি যদি ধরেই নেন কোনদিন শিখতে পারবেন না, তাহলে তো কোনদিনই শিখতে পারবেন না। ঠিক না?
জ্বি স্যার, ঠিক।
আচ্ছা, আজ তাহলে যান।
বেরুবার সময় তিনি দরজায় ধাক্কা খেলেন। ডান চোখের উপর কপাল সুপুরির মত ফুলে উঠল। মাথাধরাটা আরো বাড়ল।
শওকত সাহেব মাথাধরা নিয়েই বাসায় ফিরলেন। বাসা খালি, শুধু কাজের বুয়া আছে। বাকি সবাই নাকি বিয়েবাড়িতে গেছে। ফিরতে রাত হবে। আবার না ফেরার সম্ভাবনাও আছে। কার বিয়ে শওকত সাহেব কিছুই জানেন না। তাকে কেউ কিছু বলেনি। বলার প্রয়েজন মনে করেনি। তিনি হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দার ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। এতে যদি মাথাধরাটা কমে। ইদানীং তার ঘন ঘন মাথা ধরছে। চোখ আরো খারাপ করেছে কি না কে জানে। চোখের ডাক্তারের কাছে। একবার গেলে হয়। যেতে ইচ্ছা করছে না। ডাক্তারের কাছে যাওয়া মানেই টাকার। খেলা। ডাক্তারের ভিজিট, নুতন চশমা, নতুন ফ্রেম।
কাজের বুয়া তাকে নাশতা দিয়ে গেল। একটা পিরিচে কয়েক টুকরা পেঁপে, আধবাটি মুড়ি এবং সরপড়া চা। পেঁপেটা খেতে তিতা তিতা লাগল। মুড়ি মিইয়ে। গেছে। দাতের চাপে রবারের মত চেপ্টা হয়ে যাচ্ছে। তার প্রচণ্ড খিদে লেগেছিল। তিনি তিতা পেঁপে এবং মিয়ানো মুড়ি সবটা খেয়ে ফেললেন। চা খেলেন। গরম চা খেলে মাথাধরাটা কমবে ভেবেছিলেন। কমল না। কারণ চা গরম ছিল না। এই কাজের বুয়া গরম চা বানানোর কায়দা জানে না। তার চা সবসময় হয় কুসুম গরম।
শওকত সাহেব মাথাধরার ট্যাবলেটের খোঁজে শোবার ঘরে ঢুকলেন। টেবিলের ড্রয়ারে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট থাকার কথা। কিছুই পাওয়া গেল না। ড্রয়ারের ভেতর হাত-আয়নাটা ঢুকানো। মনোয়ারা নিশ্চয়ই রেখে দিয়েছে। আচ্ছা, আয়নার ভেতর মেয়েটা কি এখনো আছে? শওকত সাহেব আয়না হাতে নিলেন। অস্বস্তি। নিয়ে তাকালেন। আশ্চর্য! মেয়েটা তো আছে। আগেরবার বসেছিল, এখন দাঁড়িয়ে আছে। আগের ফ্রকটাই গায়ে। মেয়েটা খুব সুন্দর তো। গোল মুখ, মায়া-মায়া চেহারা। বয়স কত হবে? এগারো-বারোর বেশি না। কমও হতে পারে। মেয়েটার গলায় নীল পুঁতির মালা। মালাটা আগে লক্ষ্য করেননি। শওকত সাহেব নিচু গলায় বললেন, তোমার নাম কি?
মেয়েটা মিষ্টি গলায় বলল, চিত্রলেখা।
বাহ, সুন্দর নাম!
মেয়েটা লাজুক ভঙ্গিতে হাসল। শওকত সাহেব আর কি বলবেন ভেবে পেলেন না। মেয়েটাকে আর কি বলা যায়? আয়নার ভেতর সে এল কি করে এটা কি জিজ্ঞেস করবেন? প্রশ্নটা মেয়েটার জন্যে জটিল হয়ে যাবে না তো? জটিল প্রশ্ন। জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগে মেয়েটা বলল, আপনার কপালে কি হয়েছে?
ব্যথা পেয়েছি। জিএম সাহেবের ঘর থেকে বের হবার সময় দরজায় ধাক্কা খেলাম।
খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন?
খুব বেশি না। তুমি কোন ক্লাসে পড়?
আমি পড়ি না।
স্কুলে যাও না?
উহুঁ।
আয়নার ভেতর তুমি এলে কি করে?
তাও জানি না।
তোমার বাবা-মা, তারা কোথায়?
জানি না।
তোমরা মা-বাবা আছেন তো? আছেন না?
জানি না।
তুমি কি একা থাক?
হুঁ।
শওকত সাহেব লক্ষ্য করলেন মেয়েটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বুকের উপর দুটা হাত আড়াআড়ি করে রাখা। মনে হয় তার শীত লাগছে। অথচ এটা চৈত্র মাস। শীত লাগার কোন কারণ নেই। তিনি নিজে গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তার বাতাসটা পর্যন্ত গরম।
কাঁপছ কেন? শীত লাগছে নাকি?
হুঁ, এখানে খুব শীত।
তোমার কি গরম কাপড় নেই?
না।
তোমার এই একটাই জামা?
হুঁ।
আমাকে তুমি চেন?
চিনি।
আমি কে বল তো?
তা বলতে পারি না।
আমার নাম জান?
আপনি তো আপনার নাম বলেননি। জানব কিভাবে?