আমি ক্ষীণস্বরে বললাম, সিরাজউদ্দিন সাহেবেরও দাওয়াত ছিল?
হ্যাঁ ছিল। কলেজ স্টাফের সবাইকে বলেছিলাম।
তারপর কী হলো বলুন?
আর বলার কিছু নেই। রোজই ওরকম হতে লাগল।
কখন হতো?
রাত দশটা সাড়ে দশটা।
আমি কোনো কথা না বলে পরপর দুটা সিগারেট শেষ করলাম। চা খাওয়া হয়ে গিয়েছে, এখন আমার চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু যেতে পারছি না। আমি নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললাম, সিরাজউদ্দিন সাহেব কি প্রায়ই আসে নাকি এখানে?
আসে। আমার ছোট ছেলেটাকে প্রাইভেট পড়ায়। সিনসিয়ার লোক। রোজ সাতটার সময় আসে, রাত দশটা সাড়ে দশটার আগে যায় না।
আমি কি আপনার ছেলেটাকে একটু দেখতে পারি?
তিনি বেশ অবাক হলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে। আমি তার সঙ্গে গেলাম। না গেলেই ভালো করতাম। সাতাশ আটাশ বছরের একটা ছেলে। দড়ি দিয়ে বাঁধা। কী যে অসহায় লাগছে। ছেলেটি আমার দিকে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, একে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করান।
ঢাকাতেই তো ছিল। কোনোরকম উন্নতি হয় না। টাকার শ্রাদ্ধ। এখানে বরঞ্চ ভালো আছে। সিরাজউদ্দিনের সঙ্গে বেশ খাতির। সে এলে শান্ত থাকে। প্রায় স্বাভাবিক আচরণ করে।
তা-ই নাকি?
জী। কয়েকদিন ধরে সিরাজ আসছে না। আপনাকে নিয়ে ব্যস্ত। তাই ছেলেটার উগ্র স্বভাব হয়ে গেছে। গত পরশু বঁটি নিয়ে তার মাকে কাটতে গিয়েছিল।
সিরাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে কথাটথা বলে?
না, কথাটথা কিছু না। চুপচাপ থাকে, ও এলে খুশি হয় এইটা বুঝি। মুচকি মুচকি হাসে। সিরাজউদ্দিন গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে একেবারে শান্ত হয়ে যায়।
আমি তাকিয়ে আছি ছেলেটির দিকে। সে গোঙানির মতো একটা চাপা শব্দ করছে। মুখ থেকে অনবরত লালা বেরুচ্ছে। মুখ ঈষৎ হাঁ হয়ে আছে। একটু আগেই তাকে অসহায় লাগছিল, এখন সেরকম লাগছে না। বরং কেমন যেন ভয়ংকর লাগছে।
আমি ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বললাম, প্রিন্সিপাল সাহেব, আমাকে আজ রাতেই ঢাকা চলে যেতে হচ্ছে।
কী বললেন?
আমি কিছুতেই থাকতে পারছি না। কেন পারছি না সেই কারণও আপনার কাছে ব্যাখ্যা করতে পারছি না। কোনোদিন পারব বলেও মনে হয় না।
আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
আপনি পরীক্ষা কয়েকদিন পিছিয়ে দিন। নতুন এগজামিনার এসে বাকিটা শেষ করবে।
অসম্ভব কথা আপনি বলছেন।
তা বলছি। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে।
সেই রাতেই আমি ঢাকা চলে আসি। এই অস্বাভাবিক ঘটনাটি স্মৃতি থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলি। নিজেকে বোঝাই যে সমস্তটাই ছিল উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। গ্রামে নির্জনতা কোনো-না-কোনোভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছিল।
এই ঘটনার প্রায় চার বছর পর সিরাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা। আমি তাকে চিনতে পারিনি। তিনি বায়তুল মোকাররমের ফুটপাত থেকে উলেন সোয়েটার কিনছিলেন। তিনি আমাকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন।
স্যার, আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি সিরাজ।
চিনতে পেরেছি।
ঐ বার স্যার কাউকে কিছু না বলে হুট করে চলে এলেন। পরীক্ষা এক মাস পিছিয়ে গেল। কী দুর্দশা ছাত্রদের। গরিবের ছেলেপুলে।
আমি কঠিন স্বরে বললাম, আপনারা সবাই ভালো তো?
জী ভালো।
প্রিন্সিপাল সাহেব, উনি ভালো আছেন?
উনার খবরটা জানি না। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে জামালপুর চলে গেলেন।
ছেলেটা মারা গেছে বুঝি?
জী, বড়ই দুঃখের কথা। পাগল মানুষ বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় চলে গেল। নানান জায়গায় খোঁজাখুঁজি। তিন দিন পর নদীতে লাশ ভেসে উঠেছে। আমিই খুঁজে পাই। আমার বাড়ির পাশের ঘাটে গিয়ে লেগেছিল।
তা-ই বুঝি?
জী স্যার। খুবই আফসোসের কথা।
এখন কি নতুন প্রিন্সিপাল এসেছেন?
জী, খুবই ভালো লোক। প্রায়ই যাই উনার বাসায়। আমাকে খুব আদর করেন। উনার সঙ্গে গল্পগুজব করি।
খুবই ভালো কথা।
তবে স্যার অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন? নতুন প্রিন্সিপাল সাহেবের স্ত্রী মাঝে মাঝে বিনা কারণে ভয় পেয়ে চিৎকার চঁাচামেচি করেন। অবিকল আগের প্রিন্সিপাল সাহেবের ছেলের মতো অবস্থা। মনে হয় বাড়িটার একটা দোষ আছে।
আমি কঠিন চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সিরাজউদ্দিন বলল, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে বড় ভালো লাগছে স্যার। আপনার কথা আমার প্রায়ই মনে হয়।
সিরাজউদ্দিন হাসল। তার হাসিতে শিশুর সারল্য। চোখ দুটি মমতায় আর্দ্র।