কিছু হয়নি। মাথাটা কেমন যেন করল।
মাথা ধুইবেন স্যার? নদীর পানি দিয়া…।
মাথা ধুতে হবে না। চলো রওনা দিই।
বলেও রওনা দিতে পারলাম না। ভয় একেবারেই নেই কিন্তু শরীর অবসন্ন। অসম্ভব ঘুম পাচ্ছে।
কালিপদ!
জে আজ্ঞে?
একটু আগে তোমার কি কোনো ভয়টয় লেগেছে?
জে না।
ও আচ্ছা! চলো আস্তে আস্তে হাঁটি।
কালিপদ বারবার মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখছে। পাগল ভাবছে কি না কে জানে! ভাবলেও তাকে দোষ দেয়া যায় না। যে-লোক মাঝরাত্রিতে বেড়াতে বের হয়, অকারণে ভয় পেয়ে আধমরা হয়ে যায় সে আর যা-ই হোক খুব সুস্থ নয়।
পরের দিনটা আমার খুব খারাপ কাটল। কিছুতেই মন বসাতে পারি। ভাইভা শুরু হয়েছে। ছাত্রদের প্রশ্নের জবাবগুলিও ঠিকমতো শুনছি না। বি.এস-সি পরীক্ষা দিতে এসে একজন দেখি সোডিয়াম ক্লোরাইডের ফরমুলাতে দুটি ক্লোরিন অ্যাটম দেখাচ্ছে। প্রচণ্ড রাগ হবার কথা। রাগও হচ্ছে না। পাস নম্বর দিয়ে বিদায় করে দিচ্ছি। কেমিস্ট্রির হেড বললেন, আপনার কি শরীর খারাপ?
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, হ্যাঁ, কিছুতেই মন বসছে না। খুব টায়ার্ড লাগছে।
রাতে ঘুম কেমন হয়েছে?
ঘুম ভালোই হয়েছে।
যদি হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস করেন তাহলে এক ডোজ ওষুধ দিতে পারি।
আমি বিরক্ত স্বরে বললাম, আপনি কি হোমিওপ্যাথিও করেন?
জী। ছোটখাটো একটা ডিসপেনসারি আছে। রুগীটুগি ভালোই হয়।
মফস্বল কলেজের টিচারদের এই এক জিনিস। একটিমাত্র পেশায় তারা খুশি নন। প্রত্যেকের দ্বিতীয় কোনো পেশা আছে। কোন পেশাটি প্রধান বোঝা মুশকিল।
কী স্যার, হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস আছে?
জী না, ভূতপ্রেত এবং হোমিওপ্যাথি এই তিন জিনিস আমি বিশ্বাস করি না। আপনি কিছু মনে করবেন না।
ভদ্রলোক মুখ কালো করে বললেন, হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করেন না কেন? এটা তো হাইলি সাইন্টিফিক ব্যাপার। হ্যানিম্যান সাহেবের কথাই ধরেন। উনি নিজে একজন পাস-করা ডাক্তার ছিলেন।
হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে আমি একগাদা কথা বলতে পারতাম। টু হানড্রেড পাওয়ারের একটি ওষুধে যে আসলে কোনো ওষুধই থাকে না সেটা মোলার কনসাইট্রেশন এবং অ্যাবাগেড্রো নাম্বার দিয়ে সহজেই প্রমাণ করা যেত। তর্কের ক্ষেত্রে সবসময় তাই করি। আজ ইচ্ছা করছে না। পাঁচটা বাজতেই উঠে পড়লাম। পরীক্ষা তখনও চলছে–চলতে থাকুক। আমি বললাম, আপনারা ভাইভা শেষ করে দিন, আমি ঘরে চলে যাব।
প্রিন্সিপাল সাহেবের বাসায় আপনার না চা খাওয়ার কথা?
ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে পড়ায় মেজাজ আরো খারাপ হলো। কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। তবু যেতে হবে।
প্রিন্সিপাল সাহেবও দাওয়াতের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। আমাকে দেখে অনেকক্ষণ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, ও আচ্ছা আচ্ছা। আসুন আসুন। চা খেতে বলেছিলাম তা-ই না? কিছু মনে নেই। আসুন বারান্দায় বসি। নানান ঝামেলায় আছি ভাই।
তিনি আমাকে বসিয়ে রেখে ভেতরে চলে গেলেন। অনেকক্ষণ তাঁর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। দরজা ধরে পাঁচ-ছবছর বয়সের মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ে কৌতূহলী চোখে আমাকে দেখছে। এর সঙ্গে দুএকটা কথা বলা উচিত কিন্তু ইচ্ছা করছে না। বাড়ির ভেতর থেকে হিংস্র পশুর গর্জনের মতো গর্জন কানে আসছে। একটি মেয়েও কাঁদছে। কখনো কখনো কান্না থেমে যাচ্ছে আবার শুরু হচ্ছে। এইরকম অবস্থায় চায়ের জন্যে অপেক্ষা করাটাও অপরাধ।
অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। ছেলেটা বড় ঝামেলা করছে। শুনেছেন বোধহয়?
জী শুনেছি।
ভালো খবর কেউ কখনো শোনে না, কিন্তু এইসব খবর সবাই শুনে ফেলে। নিতান্ত অপরিচিত লোকও এসে গায়ে পড়ে বিচিত্র সব চিকিৎসার কথা বলে।
আমি চুপ করে রইলাম। প্রিন্সিপাল সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, সেই জাতীয় চিকিৎসা এখন হচ্ছে। সাত নদীর পানিতে গোসল। ঠাণ্ডায় গোসল দিয়ে নিউমোনিয়া বাধাবে।
ডাক্তারি চিকিৎসা করাচ্ছেন না?
তাও আছে। বৈজ্ঞানিক-অবৈজ্ঞানিক সবরকম চিকিৎসাই চলছে। কোনোটাই লাগছে না।
অসুখটা শুরু হলো কীভাবে?
প্রিন্সিপাল সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে হয়তো তার ইচ্ছা করছে না। চা চলে এল। শুধু চা নয়। মিষ্টি, শিঙাড়া, কচুরি।
নিন চা নিন। খিদে না থাকলে এই খাবারগুলি খাবেন না, সবই দোকানের কেনা। এদিকে আবার খুব ডায়রিয়া হচ্ছে।
চা-টা চমৎকার। এক চুমুক দিয়েই মাথাধরাটা অনেকখানি সেরে গেল। প্রিন্সিপাল সাহেব অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, কী করে অসুখটা শুরু হলো সত্যি জানতে চান?
বলতে ইচ্ছে না করলে থাক।
না না শুনুন। গত বছর গরমের সময় আমার এই ছেলে তার বউকে নিয়ে এখানে আসে। আমি অনেক দিন থেকেই আসতে বলছিলাম, ছুটি পায় না আসতে পারে না। ব্যাংকের চাকরি ছুটিছাটা কম। সাতদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। আমি এখানে এসেছি দুবছর আগে। ছেলে প্রথম এল। আমরাও খুব খুশি।
রাত্রিবেলা বেশ গল্পগুজব করছি। সিরাজউদ্দিন এসেছে। সাপের গল্পট করছে। রাত দশটার দিকে সিরাজউদ্দিন চলে যেতেই ছেলে যেন কেমন হয়ে গেল। থরথর করে কাঁপছে। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে। কোনোমতে বলল, তার নাকি অসম্ভব ভয় লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে স্বাভাবিক হয়ে গেল। হাসি-তামাশা করতে লাগল। তখন কিছু বুঝতে পারিনি, এখন বুঝছি ঐ রাতেই তার পাগলামির প্রথম শুরু।
প্রিন্সিপাল সাহেব চুপ করলেন। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে শুনছি। আমার শরীর দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ। প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, কয়েকদিন পর আবার এরকম হলো। সেও রাতের বেলা। কলেজের কিছু প্রফেসরকে খেতে বলেছিলাম। তারা খাওয়াদাওয়া করে চলে যাবার পর আবার আমার ছেলে ঐরকম করতে লাগল।