কালিপদ, নদীর নাম কী?
বিরুই নদী।
বিরুই চালের কথা শুনেছি, এই নামে যে নদীও আছে কে জানত! নদী পার হতে হবে?
আজ্ঞে না।
এসে পড়েছি নাকি?
হ।
সে হ বলেও থামছে না। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না কোথাও থামবে। মনে হচ্ছে এটা আমাদের অনন্ত যাত্রা। সিরাজউদ্দিনের সঙ্গে কথাবার্তা কী বলব কিছুই ঠিক করিনি। আগে থেকে ঠিকঠাক করে গেলে কোনো লাভ হয় না। আসল কথা বলবার সময় ঠিক করে রাখা কথা একটাও মনে আসে না। কতবার এরকম হয়েছে। যৌবনে জরি নামের একজন কিশোরীর সঙ্গে বেশ ভালো পরিচয় ছিল। খুব সাহসী মেয়ে। সে নিজ থেকেই একবার আমাকে খবর পাঠাল আমি যেন সন্ধ্যাবেলায় তাদের ছাদে অপেক্ষা করি। সারাদিন ভাবলাম ছাদের নির্জনতায় কীসব কথা বলব। কতটুকু আবেগ থাকবে। কোন পর্যায়ে হাতে হাত রাখব। বাস্তবে তার কিছুই হলো না। প্রচণ্ড ঝগড়া বেধে গেল। জরি কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ছোটলোক। আমি কড়া গলায় বললাম, আমি ছোটলোক না, ছোটলোক হচ্ছ তুমি। শুধু তুমি একা না, তোমার বাড়ির সবাই ছোটলোক। এবং তোমার বড় মামা একটা ইতর। আবেগ ভালোবাসার একটি কথাও দুজনের কেউ বললাম না।
স্যার, এই বাড়ি।
আমি থমকে দাঁড়ালাম। ছোট্ট একটা টিনের ঘর। কলাগাছ দিয়ে ঘেরা। খড়-পোড়ানো গন্ধ আসছে। পরিষ্কার ঝকঝকে উঠান। উঠানে দাঁড়াতেই কুকুর ডাকতে লাগল। চোর ভেবেছে বোধহয়। ভেতর থেকে সিরাজউদ্দিন চঁাচাল, কে, কে? কালিপদ বলল, দরজাটা খুলেন। আমি কালিপদ। দরজা সঙ্গে সঙ্গে খুলল না। হারিকেন জ্বালানো হলো। তাতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। সিরাজউদ্দিন একটি লুঙ্গি পরে খালিগায়ে বের হয়ে এল। চোখ কপালে তুলে বলল, স্যার আপনি?
দেখতে এলাম আপনাকে। কেন?
কোনো কারণ নেই। ঘুম আসছিল না, ভাবলাম দেখি রাতের বেলা গ্রাম কেমন দেখা যায়। আপনি বোধহয় শুয়ে পড়েছিলেন? ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?
জী।
খুব লজ্জিত, কিছু মনে করবেন না।
আসেন, ভেতরে এসে বসেন।
সিরাজউদ্দিন সাহেবের বিস্ময় এখনও কাটেনি। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, কোনো ঝামেলা হয়েছে স্যার?
না না, ঝামেলা কী হবে? বেড়াতে এসেছি। একটু অসময়ে চলে এলাম এই আর কি!
স্যার, একটু চা করি?
অসুবিধা না হলে করেন।
না না, কোনো অসুবিধা নাই। কোনো অসুবিধা নাই।
সিরাজউদ্দিন সাহেব ছুটাছুটি শুরু করলেন। উঠোনে চুলা জ্বালানো হলো। কালিপদ দেখলাম টাকা নিয়ে আবার ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। হয়তো চা বা চিনি নেই, আনতে গেছে। এই রাতদুপুরে কোথায় এসব পাবে কে জানে!
সিরাজউদ্দিন সাহেব!
জী স্যার?
লোকজন দেখছি না যে? আপনি একাই থাকেন নাকি?
বিয়েশাদি তো করি নাই।
করেননি কেন?
ভাগ্যে ছিল না। কষ্টের সংসার ছিল। নিজেই খেতে পেতাম না।
এখন তো বোধহয় অবস্থা সেরকম না।
জী এখন মাশাআল্লাহ সামলে উঠেছি। কিছু জমিজমাও করেছি।
তা-ই নাকি?
অতি অল্প। ধানি জমি।
একা একা থাকেন ভয় লাগে না?
ভয় লাগবে কেন?
সিরাজউদ্দিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি খানিকটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। ভয়ের ব্যাপারটা নিয়েই আমি আলাপ করতে চাই। কিন্তু কীভাবে সেটা করা যায়? আমি ইতস্তত করে বললাম, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?
জী না। এইসব হচ্ছে কুসংস্কার। এই গ্রামেই একটা রেন্ট্রি গাছ আছে। লোকে নানান কথা বলে। কী কী নাকি দেখে। আমি কোনোদিনই দেখি নাই। রাতবিরাতে কত যাওয়া-আসা করেছি।
চা তৈরি হয়েছে। চিনি ছিল না। খেজুর রসের চা। চমৎকার পায়েস পায়েস গন্ধ। কাপে চুমুক দিতে দিতে সিরাজউদ্দিন বললেন, তবে জিন বলে একটা জিনিস আছে।
আমি কৌতূহলী হয়ে বললাম, আপনি বিশ্বাস করেন?
করব না কেন? কোরান শরিফে পরিষ্কার লেখা জিন এবং ইনসান। হাশরের দিনে মানুষের যেমন বিচার হবে, জিনেরও হবে।
আপনি জিন দেখেছেন কখনো?
জী না। সাধারণ লোকে দেখে না।
আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। সিরাজউদ্দিন লোকটি আসলেই সাধারণ। কোনোরকম বিশেষত্ব নেই। আমার হঠাৎ ভয়ের সঙ্গে এই লোকটিকে কিছুতেই জড়ানো যাচ্ছে না। সরাসরি এই প্রসঙ্গটা আনাও মুশকিল। তবু একবার বললাম, আপনি চলে আসার পর ঐ রাতে কেমন যেন হঠাৎ করে ভয় পাই।
সিরাজউদ্দিন সাহেব সঙ্গে সঙ্গে উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, সাপ জিনিসটা তো ভয়েরই। ভয় পাওয়াটা ভালো। তাহলে সাবধানে চলাফেরা করবেন। অসাবধান হলেই সর্বনাশ। রাতে বের হলে টর্চলাইটটা সঙ্গে রাখবেন। শব্দ করে পা ফেলবেন।
বিদায় নিতে রাত একটা বেজে গেল। সিরাজউদ্দিন আমার সমস্ত আপত্তি আগ্রাহ্য করে এগিয়ে দিতে এলেন। তিনি এলেন বিরুই নদী পর্যন্ত। চাঁদের আলো আছে। চারদিক স্পষ্ট দেখা যায়। তবু তিনি জোর করে কালিপদের হাতে একটা হারিকেন ধরিয়ে দিয়ে উলটোদিকে রওনা হলেন। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। যতক্ষণ তাকে দেখা যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। যেই মুহূর্তে তিনি বাঁশবনের আড়ালে পড়লেন ঠিক সেই মুহূর্তে আবার সেইরকম হলো। অন্ধ যুক্তিহীন ভয়। যেন ভয়ংকর অশুভ একটাকিছু আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ছুটে আসছে। সেই অশুভ জিনিসটাকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু আমি রক্তের প্রতি কণিকায় তাকে অনুভব করছি। এর ক্ষমতা অসাধারণ। এ অন্য জগতের কেউ। এ-জগতে তাকে কেউ জানে না। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় কাঁপিয়ে দিয়ে ভয়টা চলে গেল। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে লক্ষ করলাম আমি মাটিতে বসে আছি। কালিপদ আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলছে, কী হইল স্যার? কী হইল?