এগজামিনারদের একটা দায়িত্ব হচ্ছে লক্ষ রাখা যেন ছাত্ররা তাদের নিজেদের কাজগুলি নিজেরাই করে। কিন্তু সবসময় দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না। দেখেও না-দেখার ভান করতে হয়। এখন যেমন করছি। ছাত্রদের জন্যে আমার খানিকটা মমতাও লাগছে। যন্ত্রপাতি নেই, কেমিক্যালস নেই, স্যারদের কোনো আগ্রহ নেই, ছেলেরা করবে কী?
দুপুরবেলা প্রিন্সিপাল সাহেব দেখতে এলেন পরীক্ষা কেমন হচ্ছে। ভদ্রলোককে মনে হয় বিপর্যস্ত। কিছুক্ষণ মুখ কুঁচকে রেখে বললেন, দেন, সবকটিকে ফেল করিয়ে দেন। ঝামেলা চুকে যাক।
কোনো প্রিন্সিপালকে এরকম কথা বলতে শুনিনি। আমি হেসে ফেললাম। প্রিন্সিপাল সাহেব বললেন, রাতে অসুবিধা হয়নি তো?
জী না, হয়নি।
সিরাজউদ্দিনকে আপনার খোঁজখবর রাখতে বলেছি। কোনোকিছু দরকার হলেই তাকে বলবেন। সংকোচ করবেন না।
না করব না।
সাপের গল্প বলে মাথা খারাপ করিয়ে দেবে। পাত্তা দেবেন না। এখানে সাপের উপদ্রব একেবারেই নেই।
তা-ই নাকি?
আপনাকে ভয় খাইয়ে দিয়েছে বোধহয়? আমাকেও দিয়েছিল। প্রথম যখন আসি, এমন অবস্থা, ঘর থেকে বেরুবার আগে হারিকেন, লাঠি এইসব নিয়ে বের হতাম। হা হা হা।
প্রিন্সিপাল সাহেব বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না। আগামীকাল সন্ধ্যায় চা খাবার দাওয়াত দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে গেলেন।
পাঁচটায় পরীক্ষা শেষ হবার কথা। শেষ হলো রাত নটায়। সিরাজউদ্দিন সাহেবের বিধ্বস্ত অবস্থা। আমি হাসতে হাসতে বললাম, পরীক্ষা তো আপনার ছাত্ররা দেয়নি, দিয়েছেন আপনি। মনে হচ্ছে ভালোই দিয়েছেন।
আমার সঙ্গেই তিনি ঘরে ফিরলেন। খাওয়াদাওয়া করে নিজের জায়গায় ফিরে যাবেন। অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকার জন্যেই বোধহয় আর সাপের গল্প শুরু হলো না। নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে তিনি উঠে পড়লেন।
স্যার যাই। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েন। রাতবিরাতে বেরুবার সময় একটু খেয়াল রাখবেন। শব্দ করে পা ফেলবেন। সাপেরই এখন সিজন।
খুব খেয়াল রাখব।
আমি দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসামাত্র ঠিক আগের মতো হলো। তীব্র একটা ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। থরথর করে হাত-পা কাঁপছে। নিশ্বাস নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে যাব। দরজার কড়ায় টন করে একটা শব্দ হলো। যেন কেউ কড়া নাড়তে গিয়েও কড়া নাড়ল না। ঠিক তখন ভয়টা চলে গেল। আমি পুরোপুরি স্বাভাবিক। জগ থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানি খেলাম। গলা উঁচিয়ে ডাকলাম–কালিপদ, কালিপদ! কেউ সাড়া দিল না। আজ বোধহয় ডিউটি দিচ্ছে না।
বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে এনে বসলাম। সিগারেট ধরালাম। আকাশে অল্প মেঘ। মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে চাদ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আবার ভেসে উঠছে। অপূর্ব আলোআঁধারি। ঢাকা শহরে বসে এই দৃশ্য ভাবাই যায় না। তবে বড় বেশি নির্জন। ঝিঝি ডাকছে। কিন্তু সেই ঝিঝির ডাকও ম্যাজিকের মতো হঠাৎ করে থেমে যাচ্ছে। সেই সময়টা বেশ অদ্ভুত মনে হয়। সবাই যেন বিরাট কোনো ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করছে। বইপত্র পড়ে আমার ধারণা হয়েছিল শিয়াল বোধহয় প্রহরে প্রহরে ডাকে। এই ধারণাও দেখলাম সত্যি না। সারাক্ষণই শিয়াল ডাকছে। সেই ডাকের মধ্যে একটা করুণ ব্যাপার আছে, শুনতে ভালো লাগে।
ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে নিয়ে আবার এসে বসলাম বারান্দায়। আর তখন দেখলাম কালিপদ আসছে। তার হাতে একগাদা এঁটো বাসনকোসন। সম্ভবত পুকুরে ধোবে।
এই কালিপদ!
আদাব স্যার।
একটু শুনে যাও তো!
কালিপদ এগিয়ে এসে মাথা নুইয়ে প্রণাম করল। হিন্দুদের প্রণামের এই ভঙ্গিটি বেশ সুন্দর।
রাতদুপুরে ধুতে যাচ্ছ নাকি?
হ স্যার।
আচ্ছা, তুমি কি সিরাজউদ্দিন সাহেবের বাসা চেন?
আজ্ঞে চিনি।
কতদূর?
দুই মাইলের উপরে হইব।
কালিপদ, তুমি একটা কাজ করতে পারবে?
নিশ্চয়ই পারব স্যার, বলেন।
তুমি কি আমাকে ওঁর বাসায় নিয়ে যেতে পারবে?
কালিপদ অবাক হয়ে বলল, এখন?
হ্যাঁ এখন। তুমি তোমার কাজ সেরে আসো, তারপর যাব।
আমি উনারে ডাইকা নিয়ে আসি?
না, ডেকে আনতে হবে না। আমিই যাব। তোমার কোনো অসুবিধা আছে?
আজ্ঞে না, অসুবিধা নাই। আমি আসতাছি।
সিরাজউদ্দিনের বাসায় যাবার ব্যাপারটা যে আমি ঝোঁকের মাথায় করলাম তা না। আমার নিশ্চিত ধারণা হয়েছে যে সিরাজউদ্দিনের সঙ্গে আমার হঠাৎ ভয় পাবার একটা সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক বের করতে না পারলে আজ রাতেও আমার ঘুম হবে না। আধিভৌতিক কোনো ব্যাপারেই আমার বিশ্বাস নেই। কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়া এ-পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না। বস্তুজগতের প্রতিটি বস্তুকেই নিউটনের গতিসূত্র মানতে হয়।
ডালভাঙা ক্রোশ বলে একটা কথা বইপত্রে পড়েছি। আজ রাতে সেটা বাস্তবে জানা গেল। হাঁটছি তো হাঁটছিই। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করছি, কালিপদ আর কতদূর? সে তার উত্তরে ফোৎ-জাতীয় একটা শব্দ করছে। লোকটি কথা কম বলে, কথাবার্তা হা না-র মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিংবা কে জানে গ্রামট্রামের দিকে হয়তো চলতি অবস্থায় কথা কম বলার নিয়ম। তার ওপর লক্ষ করলাম লোকটি একটু ভীতু টাইপের, কোনো শব্দ হতেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আমি যখন বলছি— কী হলো কালিপদ? তখন আবার হাঁটা শুরু করছে। আমি আগেও দেখেছি দারোয়ানরা সবসময় ভীতু ধরনের হয়।
একসময় আমরা ছোটখাটো একটা নদীর ধারে চলে এলাম। বর্ষাকালে এর চেহারা রমরমা থাকলেও থাকতে পারে, এখন দেখাচ্ছে সরু ফিতার মতো। পায়ের পাতাও হয়তো ভিজবে না।