তা-ই নাকি?
জী। আপনি গরু খান তো?
জী, খাই।
এখানে কসাইখানা নাই। মাঝে মাঝে গরু কাটা হয়। আজ হাটবার। তাই গরু কাটা হয়েছে। প্রিন্সিপাল সাহেব দুই ভাগ নিয়েছেন।
ও আচ্ছা।
পঁচিশ টাকা করে ভাগ।
তা-ই বুঝি?
প্রিন্সিপাল স্যারের স্ত্রীর রান্না খুব ভালো।
তা-ই নাকি?
জী। তবে আজ রান্না করছে তার ছেলের বউ। যে-ছেলেটা পাগল তার বউ।
ও আচ্ছা।
বিরাট অশান্তি চলছে প্রিন্সিপাল স্যারের বাড়িতে। ছেলে বঁটি নিয়ে তার মাকে কোপ দিতে গেছে। বউ গিয়ে মাঝখানে পড়ল। এখন ছেলেকে বেঁধে রেখেছে। এইজন্যেই রান্নায় দেরি হচ্ছে।
কোনো হোটেলে গিয়ে খেয়ে এলেই হতো। এদের দুঃসময়ে…
কী যে বলেন স্যার! আপনি আমাদের মেহমান না? তা ছাড়া ভ্রলোকের খাওয়ার মতো হোটেল এই জায়গায় নাই। নিতান্তই গণ্ডগ্রাম। হঠাৎ সাবডিভিশন হয়ে গেল। ভালো একটা চায়ের দোকান পর্যন্ত নাই।
রাত সাড়ে দশটায় খাবার এল। দুটো প্লেট, সিরাজউদ্দিন সাহেবও আমার সঙ্গে খেতে বসলেন। হাত ধুতে ধুতে বললেন, প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে আপনার সঙ্গে খেতে বলেছেন। আপনি হচ্ছেন আমাদের মেহমান। আপনি একা একা খাবেন, তা কি হয়!
প্রিন্সিপাল সাহেবের ছেলের বউ অনেক কিছু রান্না করেছে। অসাধারণ রান্না। সামান্য সব জিনিসও রান্নার গুণে অপূর্ব হয়েছে। মেয়েটার জন্যে আমার কষ্ট হতে লাগল। বেচারি হয়তো চোখের জল ফেলতে ফেলতে বেঁধেছে। আজ রাতে হয়তো কিছু খাবেও না।
সিরাজউদ্দিন সাহেব!
জী স্যার?
প্রিন্সিপাল সাহেবের ছেলের বউকে বলবেন, আমি এত ভালো রান্না খুব কম খেয়েছি। দ্রৌপদী এরচে ভালো রাঁধত বলে আমার মনে হয় না।
জী স্যার, বলব। তবে প্রিন্সিপাল স্যারের স্ত্রীর রান্নার কাছে এ কিছুই। আছেন তো কিছুদিন নিজেই বুঝবেন।
প্রিন্সিপাল সাহেবকে বেশ বিচক্ষণ বলে মনে হলো। তিনি একটা টর্চলাইট পাঠিয়েছেন। ফ্লাস্কভরতি চা পাঠিয়েছেন। পান সুপারি জর্দাও আছে কৌটায়।
খাওয়াদাওয়ার পর সিরাজউদ্দিন সাহেব অনেকক্ষণ বসে রইলেন। চা খেলেন, পান খেলেন, দীর্ঘ একটা সাপের গল্প বললেন। বিদায় নিলেন রাত এগারোটার পর। যে-লোকটি ক্রমাগতই সাপের কথা বলছে তার দেখলাম তেমন ভয়টয় নেই। টর্চ বা লাঠি ছাড়াই দিব্যি হনহন করে চলছে।
আমি দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলাম। নতুন জায়গায় চট করে ঘুম আসবে না। শুয়ে শুয়ে হালকা ধরনের কিছু বই পড়া যায়। হারিকেনের এই আলোয় সেটা সম্ভব হবে না। আমি সিগারেট ধরিয়ে সুটকেস খুললাম বই বের করব। ঠিক তখন একটা কাণ্ড হলো। প্রচণ্ড ভয় লাগল। অথচ ভয়ের কোনোই কারণ ঘটেনি। তবু আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। যেন বন্ধ দরজার ওপাশেই অশরীরী কিছু দাঁড়িয়ে আছে। যেন এক্ষুনি সেই অশরীরী অতিথি ভয়ংকর কিছু করবে। নিজের অজান্তেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম–কে, কে? আর তখন শুনলাম থপ থপ শব্দে একজন কেউ যেন দূরে চলে যাচ্ছে। ছোট্ট একটা কাশির শব্দও শুনলাম।
ভয়টা যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি হঠাৎ চলে গেল। আমি খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। চাঁদের আলোয় চারদিক থৈথৈ করছে। কোথাও কেউ নেই। হঠাৎ এই অস্বাভাবিক ভয় আমাকে অভিভূত করল কেন? এখনও গা ঘামে ভেজা। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। আমি শারীরিকভাবে পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। হালকা বাতাস দিচ্ছে, বেশ লাগছে দাঁড়িয়ে থাকতে। লুঙ্গিপরা খালি গায়ের একটি লোক বিড়ি টানতে টানতে আসছে। আমাকে দেখেই বিড়ি লুকিয়ে ফেলে বলল, আদাব স্যার।
আদাব। তুমি কে?
আমার নাম কালিপদ। আমি কলেজের দারোয়ান।
তুমি কিছুক্ষণ আগে কি এইখানেই ছিলে?
জী স্যার। লাইব্রেরি ঘরের সামনে বসে ছিলাম।
কাউকে যেতে দেখেছ?
আজ্ঞে না। কেন স্যার? কী হইছে?
না, এমনি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ইলেকট্রিসিটি চলে এল। আমি নিশ্চিন্ত মনে বই নিয়ে শুতে গেলাম। স্টিফান কিংয়ের লেখা ভৌতিক উপন্যাস। দারুণ রগরগে ব্যাপার। একবার পড়তে শুরু করলে ছাড়তে ইচ্ছা করে না। ভয়ভয় লাগে আবার পড়তেও ইচ্ছা করে। পুরোপুরি ঘুমুতে গেলাম একটার দিকে। বারবার মনে হতে লাগল কিছুক্ষণ আগে এই অস্বাভাবিক ভয়টা কেন পেলাম? রহস্যটা কী?
আমি খুব একটা সাহসী মানুষ এরকম দাবি করি না। কিন্তু অকারণে এত ভয় পাবার মতো মানুষও আমি নই। একা একা বহু রাত কাটিয়েছি।
সে-রাতে আমার ভালো ঘুম হলো না।
দিনের বেলাটা খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। একুশজন ছেলে পরীক্ষা দেবে। জোগাড়যন্ত্র কিছুই নেই। ল্যাবরেটরির অবস্থা শোচনীয়। একটামাত্র ব্যালেন্স তাও ঠিকমতো কাজ করছে না। প্রয়েজনীয় কেমিক্যালসও নেই। সে নিয়ে কারো মাথাব্যথাও নেই। কেমিস্ট্রির দুজন টিচার। ওঁরা নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছেন। একজন আমাকে বলে গেলেন, কলেজের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। ক্লাস-টেলাসও তেমন হয়নি। একটু দেশেশুনে নেবেন স্যার। পাস মার্কটা দিয়ে দেবেন।
আমি হেসে বললাম, কী করে দেব বলুন। দেবার তো একটা পথ লাগবে। এরা তো মনে হচ্ছে প্র্যাকটিক্যাল কাজ কিছুই করেনি।
কী করে করবে বলেন। স্ট্রাইক-ফ্রাইক লেগেই আছে। জিনিসপত্রও কিছু নেই।
একমাত্র সিরাজউদ্দিন সাহেবকে দেখলাম ব্যবস্থা করার জন্য ছুটাছুটি করছেন। চেষ্টা করছেন কীভাবে ছাত্রদের খানিকটা সাহায্য করা যায়। একুশজন ছাত্রছাত্রীর কেউ তাঁকে এক মুহূর্তের জন্যে চোখের আড়াল করতে রাজি নয়। একটি মেয়ে সল্ট অ্যানালিসিসে কিছুই না পেয়ে তাদের স্বভাবমতো কাঁদতে শুরু করেছে। সিরাজউদ্দিন সাহেব তাকে একটা ধমক দিলেন, খবরদার কাঁদবি না। কাঁদলে চড় খাবি। গোড়া থেকে কর। ড্রাই টেস্টগুলি আগে কর। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে করবি।