নুরুজ্জামান সাহেব না বলতে গিয়েও বললেন না। হোটেলটা তার না। কাস্টমার এসেছে, পয়সা দিয়ে খাবে। তার যেখানে ইচ্ছা সেখানে বসবে। নুরুজ্জামান সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারো সামনে খাওয়া-দাওয়া করতে তার ভাল লাগে না।
আশা করি আপনার বিরক্তি উৎপাদন করছি না।
জি না?
একটা দেয়াশলাই দিতে পারেন?
নুরুজ্জামান সাহেব দেয়াশলাই বের করে বাড়িয়ে দিলেন। তার মন আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে–বোঝাই যাচ্ছে এই লোক প্রচুর কথা বলবে। বক বক করে। মাথা ধরিয়ে দেবে। এখনো সময় আছে, তিনি ইচ্ছে করলে অন্য টেবিলে চলে যেতে। পারেন। কাজটা অভদ্রতা হয়।
আশা করি সিগারেটের ধোয়ায় আপনার অসুবিধা হচ্ছে না।
না, হচ্ছে না।
আন্তরিক ধন্যবাদ।
লোকটার অন্য কোন মতলব নেই তো? ধান্ধাবাজ না তো? বাংলাদেশে ধান্ধাবাজ লোকের কোন অভাব নেই। কয়েকদিন আগেই এরকম একজন ধান্ধাবাজের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ইস্ত্রী করা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে রীতিমত ভদ্রলোক। চোখে সোনালী রিমলেস চশমা। মুখ ভর্তি হাসি। নুরুজ্জামান সাহেব একটা হোটেলে খেতে বসেছেন, লোকটা তার সামনে বসে অত্যন্ত বিনীতভাবে বলল, স্যার, কিছু মনে করবেন না। গুলিস্তানের মোড়ে আমার মানিব্যাগটা চুরি হয়েছে। খিদেয় মরে যাচ্ছি। চারটি ভাত খাওয়ান।
এরকম সম্প্রান্ত চেহারার একজন মানুষের মুখের উপর না করা মুশকিল। লোকটা ভাত খেল। ভাত খাওয়ার পর দৈ, মিষ্টি খেল। সবশেষে মিষ্টি পান এবং একটা বেনসন সিগারেট।
নুরুজ্জামান সাহেবকে কিছু বলতে হচ্ছে না, সে নিজেই হাসিমুখে অর্ডার দিচ্ছে। কোন দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই। কি সুন্দর করে বলছে–
স্যার, আপনার অনুমতি নিয়ে একটা সিগারেট দিতে বলি। এমন চমৎকার লাঞ্চের পর সিগারেট না খেলে লাঞ্চটার অপমান করা হয়–এই বেয়ারা, একটা বেনসন নিয়ে এসো। দেখে শুনে আনবে, ড্যাম্প যেন না হয়। ড্যাম্প হলে থাবড়া খাবি।
এই লোকও সে রকম কেউ না তো? নুরুজ্জামান আড় চোখে তাকালেন। সে রকমই তো মনে হচ্ছে। অন্ধকার কোণায় এসে বসেছে, চোখে সানগ্লাস। চোখ থেকে সানগ্লাস খোলেনি। একবার রিডার্স ডাইজেস্টে পড়েছিলেন–যারা সহজে সানগ্লাস খুলতে চায় না তাদের ভেতর সমস্যা থাকে। লোকটা পোশাকে-আশাকে ভাল। খয়েরি রঙের হাফ হাওয়াই শার্ট। শাদা প্যান্ট। শাদা প্যান্টের সঙ্গে মিলিয়ে ধবধবে। শাদা চামড়ার জুতা। বিদেশী জুতা নিশ্চয়ই। সিগারেট যে খাচ্ছে দামী সিগারেটই খাচ্ছে। সুন্দর গন্ধ আসছে। সস্তা সিগারেটের দম আটকানো গন্ধ না। সিগারেট বের করেছে সিগারেট-কেস থেকে। আজকাল অবশ্যি কেউ সিগারেট কেস ব্যবহার করে না। লোকটা সিগারেট-কেস নুরুজ্জামান সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিল। নিচু গলায় বলল, আপনি কি সিগারেট খাবেন?
নুরুজ্জামান বিরক্ত মুখে বললেন, জ্বি না, আমি ভাত খাব। ভাতের অর্ডার দিয়েছি।
ভাত চলে এসেছে। সুন্দর সরু চালের ভাত। হোটেলে খাবার একটাই সুবিধা। হোটেলে তরকারি যেমনই রাধুক, ভাত ভাল রাধে। বাড়ির ভাত কখনো এ রকম হয় না, কোন কোন দিন চাল-চাল থাকে, কখনো নরম কাদার মত। এই জন্যেই তিনি বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে দিয়েছেন।
স্যার, আপনি কি আমার উপস্থিতিতে বিরক্ত বোধ করছেন?
নুরুজ্জামান হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। সবজি দিয়ে ভাত মাখতে লাগলেন। সবজির চেহারা দেখতে ভাল। খেতে কেমন কে জানে!
লালবাগের কেল্লা কেমন দখলেন স্যার?
নুরুজ্জামান চমকে উঠলেন, ঐ লোকটি লালবাগ কেল্লা থেকেই পেছনে। লেগেছে? নাশের কথা! মতলবটা কি?
আপনি যখন কেল্লা দেখছিলেন আমিও দেখছিলাম। আমি অবশ্যি এর আগেও অসংখ্যবার দেখেছি। বাংলাদেশে দেখার কিছু নেই। একই জিনিশ বারবার দেখতে হয়। লালবাগের কেল্লা আপনি কি এই প্রথম দেখলেন?
জি।
পুরানো আমলের জিনিশ দেখতে যদি আপনার ভাল লাগে তাহলে সম্রাট শাহজাহানের আমলের একটা গেট আছে, দেখে আসতে পারেন। ইউনিভার্সিটি এলাকায় যাবেন, টিএসসি এবং বাংলা একাডেমীর সামনে দিয়ে যে বড় রাস্তাটা গেছে নজরুল সরণী, ঐ রাস্তার মাথায় গেটের অংশবিশেষ আছে। জায়গাটা চিনেছেন? চার নেতার কবরের পাশে।
নুরুজ্জামান হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছেন। এরা রান্না ভাল করে। সজিটা ভাল বেঁধেছে। তারপরেও কাস্টমার কেন পাচ্ছে না? একদিন হেটেল আমানিয়াতে খেয়ে দেখতে হবে। কে জানে হয়ত ওদের রান্না। আরো ভাল।
প্রায় তিনশ বছরের পুরানো একটা গীর্জা আছে–আর্মেনিয়ান গীর্জা।
গীর্জা ফির্জা আমি দেখিনা।
স্যার, মনে হচ্ছে আমার প্রতিটি কথায় বিরক্ত হচ্ছেন। আমার পরিচয় পেলে অবশ্যি আর বিরক্ত হবেন না। আমি একজন ভ্যাম্পায়ার।
খাওয়া বন্ধ রেখে নুরুজ্জামান মুখ তুলে বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনি কি?
ভ্যাম্পায়ার? ভ্যাম্পায়ার চিনেন না? ঐ যে কাউন্ট ড্রাকুলা। ট্রানসেলভেনিয়ার বিখ্যাত কাউন্টের গল্প পড়েননি?
নুরুজ্জামান আবার খেতে শুরু করলেন, এবং মনে মনে বললেন, ব্যাটা বদমাস! ভ্যাম্পায়ার সেজেছে!
আপনার মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। না পারারই কথা। ভ্যাম্পায়ার কি সেই সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা নেই। গল্পের বই, সিনেমা থেকে আহরিত জ্ঞানের সবই ভুল।
তাই বুঝি?
জি তাই! লোকজ বিশ্বাস হচ্ছে ভ্যাম্পায়ার রাতে মানুষের রক্ত খেয়ে বেড়াবে, দিনে কফিনের ভেতর শুয়ে থাকবে। কারণ রোদ গায়ে লাগা মানে তাদের মৃত্যু। আমাকে দেখুন দিনে ঘুরে বেড়াচ্ছি।