এইসব অকারণ অর্থহীন কথা শুনতে শুনতে শওকত সাহেব ব্যাঙ্কের হিসাব মেলান। মাঝে মাঝে হিসাবে গণ্ডগোল হয়ে যায়। তার প্রচণ্ড রাগ লাগে। পুরো হিসাব আবার গোড়া থেকে করতে হয়। মনের রাগ তিনি প্রকাশ করেন না। রাগ। চাপা রেখে মুখ হাসি-হাসি করে রাখার ক্ষমতা তার আছে। মনের রাগ চেপে রেখে অপেক্ষা করেন কখন সামনে বসে থাকা মানুষটা বিদেয় হবে, তিনি তার হিসাব আবার গোড়া থেকে করতে শুরু করবেন। খুবই সমস্যার ব্যাপার। তবে মাসখানিক হল শওকত সাহেব আরো বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছেন। ব্যাংকে কম্পিউটার চলে এসেছে। এখন থেকে হিসাবপত্র সব হবে কম্পিউটারে। চেংড়া একটা ছেলে, নাম সাজেদুল করিম, সবাইকে কম্পিউটার ব্যবহার করা শেখাচ্ছে। সবাই শিখে গেছে, শওকত সাহেব কিছু শিখতে পারেননি।
যন্ত্রপাতির ব্যাপার তার কাছে সবসময়ই অতি জটিল মনে হয়। সামান্য ক্যালকুলেটারও তিনি কখনো ঠিকমত ব্যবহার করতে পারেন না। একটা বেড়াছেড়া হয়ে যায়ই। তাছাড়া যন্ত্রের উপর তার বিশ্বাস নেই। তিনি যত দায়িত্বের সঙ্গে একটা যোগ করবেন যন্ত্র কি তা করবে? কেনই বা করবে? ভুল-ভ্রান্তি করলে বড় সাহেবদের গালি খাবেন, তার চাকরি চলে যাবে। যন্ত্রের তো সেই সমস্যা নেই। যন্ত্রকে কেউ গালিও দেবে না বা তার চাকরিও চলে যাবে না। তারপরেও কেন মানুষ এত যন্ত্র-যন্ত্র করে? কম্পিউটার তার কাছে অসহ্য লাগছে। অনেকটা টেলিভিশনের। মত একটা জিনিশ। হিশাব-নিকাশ সব পর্দায় উঠে আসছে। এমিতেই টেলিভিশন তার ভাল লাগে না। বাসায় তিনি কখনো টিভি দেখেন না। যে যেটা অপছন্দ করে তার কপালে সেটাই জোটে, এটা বোধহয় সত্যি। তিনি টিভি পছন্দ করেন না। এখন টিভির মত একটা জিনিশ সবসময় তার টেবিলে থাকবে। অফিসে যতক্ষণ থাকবেন। তাকে তাকিয়ে থাকতে হবে টিভির পর্দার দিকে। যে পর্দায় গান-বাজনা হবে না, শুধু হিসাব-নিকাশ হবে। কোন মানে হয়?
অফিস শুরু হয় নটার সময়। শওকত সাহেব নটা বাজার ঠিক দশ মিনিট আগেই অফিসে ঢোকেন। তার টেবিলে পিরিচে ঢাকা এক গ্লাস পানি থাকে। তিনি পানিটা খান। তারপর তিনবার কুল হু আল্লা পড়ে কাজকর্ম শুরু করেন। এটা তার নিত্যদিনকার রুটিন। আজ অফিসে এসে দেখেন কম্পিউটারের চেংড়া ছেলেটা, সাজেদুল করিম, তাঁর টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে ভুরু কুঁচকে সিগারেট টানছে। পিরিচে ঢাকা পানির গ্লাসটা খালি। সাজেদুল করিম খেয়ে ফেলেছে নিশ্চয়ই। সাজেদুল করিম শওকত সাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, স্যার, কেমন আছেন?
ভাল আছি।
আজ আপনার জন্যে সকাল সকাল চলে এসেছি।
ও, আচ্ছা।
জিএম সাহেব খুব রাগারাগি করছিলেন। আপনাকে কম্পিউটার শেখাতে পারছি না। আজ ঠিক করেছি সারাদিন আপনার সঙ্গেই থাকব।
শওকত সাহেব শুকনো মুখে বললেন, আচ্ছা।
আমরা চা খাই, চা খেয়ে শুরু করি। কি বলেন স্যার?
শওকত সাহেব কিছু বললেন না। বেল টিপে বেয়ারাকে চা দিতে বললেন। সাজেদুল করিম হাসি হাসি মুখে বলল, গতকাল যা যা বলেছিলাম সে সব কি স্যার আপনার মনে আছে?
শওকত সাহেবের কিছুই মনে নেই, তবু তিনি হা-সূচক মাথা নাড়লেন।
একটা ছোটখাট ভাইবা হয়ে যাক। স্যার বলুন দেখি, মেগাবাইট ব্যাপারটা কি?
মনে নাই।
র্যাম কি সেটা মনে আছে?
না।
মনে না থাকলে নাই। এটা এমন কিছু জরুরী ব্যাপার না। ম্যাগাবাইট, র্যাম সবই হচ্ছে কম্পিউটারের মেমরির একটা হিসাব। একেক জন মানুষের যেমন একেক রকম স্মৃতিশক্তি থাকে, কম্পিউটারেরও তাই। কিছু কিছু কম্পিউটারের স্মৃতিশক্তি থাকে অসাধারণ, আবার কিছু কিছু কম্পিউটারের স্মৃতিশক্তি সাধারণ মানের। মেগাবাইট হচ্ছে স্মৃতিশক্তির একটা হিসাব। মেটা হল টেন টু দ্যা পাওয়ার সিক্স আর বাহঁট হল টেন টু দ্যা পাওয়ার সিক্স ভাগের এক ভাগ। র্যাম হচ্ছে র্যানডম একসেস মেমরি। স্যার, বুঝতে পারছেন?
শওকত সাহেব কিছুই বোঝেননি। তারপরেও বললেন, বুঝতে পারছি।
একটা জিনিশ খেয়াল রাখবেন–কম্পিউটার হল আয়নার মত।
আয়নার মত?
হ্যাঁ স্যার, আয়নার মত। আয়নাতে যেমন হয়–আয়নার সামনে যা থাকে তাই আয়নাতে দেখা যায়, কম্পিউটারেও তাই। কম্পিউটারকে আপনি যা দেবেন সে তাই আপনাকে দেখাবে। নিজে থেকে বানিয়ে সে আপনাকে কিছু দেবে না। তার সেই ক্ষমতা নেই। বুঝতে পারছেন?
হ্যাঁ।
স্যার, এখন আসুন মেমরি এবং হার্ড ডিস্ক এই দুয়ের ভেতরের পার্থক্যটা আপনাকে বুঝিয়ে বলি। আমার কথা মন দিয়ে শুনছেন তো?
হ্যাঁ।
শওকত সাহেব আসলে মন দিয়ে কিছুই শুনছেন না। আয়নার কথায় তার। নিজের আয়নাটার কথা মনে পড়ে গেছে। ব্যাপারটা কি? আয়নার ভেতরে ছোট মেয়েটা এল কি ভাবে? মেয়েটা কে? তার নাম কি? চোখ পিট পিট করে তার দিকে তাকাচ্ছিল।
বেয়ারা চা নিয়ে এসেছে। শওকত সাহেব চায়ের কাপে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চুমুক দিচ্ছেন। সাজেদুল করিম বলল, স্যার!
হ্যাঁ।
আপনি কি কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত?
না তো।
তাহলে আসুন কম্পিউটারের ফাইল কি ভাবে খুলতে হয় আপনাকে বলি। শুধু মুখে বললে হবে না। হাতে-কলমে দেখাতে হবে। হার্ড ডিস্ক হল আমাদের ফাইলিং ক্যাবিনেট। সব ফাইল আছে হার্ড ডিস্কে। সেখান থেকে একটা বিশেষ। ফাইল কিভাবে বের করব? …
বিকেল চারটা পর্যন্ত শওকত সাহেব কম্পিউটার নিয়ে ঘটঘট করলেন। লাভের মধ্যে লাভ হল–তার মাথা ধরে গেল। প্রচণ্ড মাথাধরা। সাজেদুল করিমকে মাথা ধরার ব্যাপারটা জানতে দিলেন না। বেচারা এত আগ্রহ করে বোঝাচ্ছে। তার ভাব। ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে কম্পিউটারের মত সহজ কিছু পৃথিবীতে তৈরি হয়নি।