কাশা নিষেধ না। আপনার কাশির ধরনটা ভাল না। পিঠে ব্যথা আছে?
নিজাম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ আছে।
মেরুদণ্ডে?
জ্বি।
সর্বনাশ! লাফ দিয়ে নামুন দেখি রিকশা থেকে।
নিজাম সাহেব রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নামলেন। ভীত গলায় বললেন, কি হয়েছে?
সাড়ে সর্বনাশ হয়ে গেছে। পিছন দিকে দেখেন।
নিজাম সাহেব পিছন ফিরে দেখলেন–তার পেছনে রঙিন এক ফিতা–ফিতার এক মাথা তার পিঠে লাগছে, অন্য মাথা বহু দূর চলে গেছে।
মোতালেব বিরক্ত হয়ে বলল, কিছু বুঝতে পারছেন?
জি না।
আরে ভাই, আপনি তো এখনো মরেন নাই। মনে হয় ডাক্তার আপনার জীবন বাচানোর চেষ্টা করছে। কিছু নির্বোধ ডাক্তার আছে না, রোগীকে বাঁচাবার জন্যে জীবন দিয়ে দেয়। একজন মরতে চাচ্ছে মরতে দাও–তা দেবে না। বাঁচিয়ে তুলবে। বাচিয়ে তুলে লাভটা কি?
নিজাম বললেন, ফিতার ব্যপারটা বুঝতে পারছি না।
আপনার রক্ত মাংসের শরীরের সঙ্গে এই ফিতা লাগানো। ফিতায় টান পড়ছে, তার মানে হল আপনাকে ঐ শরীরে ঢুকতে হবে। ব্যথা, যন্ত্রণা, চিকিৎসা চলবে–ওই, শরীরে ঢুকতে চান?
বুঝতে পারছি না।
কোন দরকার নাই। যা আছেন ভাল আছেন। দেখি চেষ্টা করে ফিতা ছিড়তে পারি কিনা। আপনিও হাত লাগান। আরো কয়েকজন ভূত পেলে ভাল হত–একসঙ্গে টানাটানি করে ছিড়ে ফেলতাম। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন–আমি দেখি কয়েকজনকে নিয়ে আসি। খবর্দার, যাবেন না। এই টেলিফোনের খামা ধরে দাঁড়ান। দু হাতে শক্ত করে খামা ধরে থাকুন, নয়ত ফিতার টানের চোটে উঠে চলে যাবেন। মহাবিপদে পড়লাম দেখি।
নিজাম সাহেব টেলিফোনের খামা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। পিঠের টান বাড়ছে। তার একবার মনে হল খামাশুদ্ধ তাকে বুঝি উড়িয়ে নিয়ে যাবে, এমন টান। ইতিমধ্যে মোতালেব তিন-চারজন ভূত নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। তারা ফিতা ছেড়ার চেষ্টা করছে। লাভ কিছু হচ্ছে না। এক সময় টান প্রবল হল–নিজাম সাহেব টেলিফোনের খামা ছেড়ে দিলেন। তার মনে হল তিনি ঝড়ের মত ছুটে যাচ্ছেন। ভয়াবহ অবস্থা! মানুষ (নাকি ভূত?) এমন বিপদে পড়ে!
নিজাম সাহেবের মাথার অপারেশন শেষ হয়েছে। নিউরোলজির সার্জেন্ট প্রফেসর ইফতেখারুল ইসলাম–হাতের গ্লাভস খুলতে খুলতে বললেন, অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে বলেই আমার ধারণা। রোগীর বেঁচে থাকার কথা। অবশ্যি চব্বিশ ঘণ্টা পার না হলে কিছু বলা যাচ্ছে না–তারপরেও আমি আশাবাদী। চোখের মণিতে আলো ফেলে দেখুন তো রিফ্লেক্স একশান কেমন?
একজন ডাক্তার নিজাম সাহেবের চোখের মণিতে আলো ফেললেন। চোখের মণি বড় বড় হয়ে আছে। নিজাম সাহেবের ভূত তার শরীরের কাছেই বসা। তিনি শরীরের ভেতর ঢোকার তীব্র আকর্ষণ বোধ করছেন–কোন দিক দিয়ে ঢুকবেন বুঝতে পারছেন না।
স্যার।
নিজাম সাহেব চমকে তাকিয়ে দেখেন মোতালেব চলে এসেছে। বোধহয় দৌড়ে এসেছে। হাপাচ্ছে।
নিজাম সাহেব মোতালেবের দিকে তাকালেন। মোতালেব বলল, খামাখা আর বসে আছেন কেন? এরা তো মনে হয় আপনাকে বাচাবেই–শরীরে ঢুকে পড়ুন।
কোন দিক দিয়ে ঢুকব?
চোখের মণি দিয়ে ঢুকে পড়ুন। চোখের মণি দিয়ে ঢোকাটা সহজ হবে।
ভয় লাগছে তো।
কচি খোকা নাকি, ভয় লাগছে! ভাবীর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না।
সেকি, হাসপাতালের বারান্দায় লম্বা হয়ে পড়ে আছে। ভাবীর সঙ্গে আপনার ছোট মেয়েটাও আছে। বেচারী বোধ হয় খুব বাপ ভক্ত। কান্নাকাটি যে ভাবে করছে বলার না।
খুব কাঁদছে?
আহারে, শুধু শুধু কথা বলে সময় নষ্ট। ঢুকে পড়ুন তো।
নিজাম সাহেব তার চোখের মণির ভেতর দিয়ে নিজের শরীরে ঢুকলেন।
যে ডাক্তার চোখের মণির উপর আলো ফেলছিল সে আনন্দিত গলায় বলল, রিফ্লেক্স একশান ভাল। চোখের মণি ছোট হচ্ছে। এ যাত্রা বোধ হয় টিকে গেল। ট্রাকের নিচে পড়েও বেঁচে যায়–এই প্রথম দেখলাম। একেই বলে ভাগ্য।
ভাইরাস
নুরুজ্জামান সাহেব বর্তমানে একজন সুখী মানুষ।
বীমা কোম্পানীতে ভাল চাকরি করতেন। সাত বছর হল রিটায়ার করেছেন। রিটায়ারের সময় গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড সব মিলিয়ে হাতে একসঙ্গে বেশ কিছু টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকা ব্যাংকে জমা আছে। ইন্টারেস্ট যা পান তাতেই তার মোটামুটি চলে যায়। স্বাস্থ্য ভাল, রোগ-ব্যাধি নেই। ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার, হার্টের সমস্যা এই জাতীয় বৃদ্ধ বয়সের রোগের কোন কিছুই তাকে এখনো ধরেনি। দুটি মেয়েই ভাল বিয়ে দিয়েছেন। একজন বরের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, অন্যজন সিঙ্গাপুরে। স্ত্রী গত হয়েছেন। নুরুজ্জামান সাহেব একা থাকেন। এই একটাই যা। সমস্যা। তবে অনেকদিন থেকেই একা আছেন বলে খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তার খারাপ লাগে না, বরং ভালই লাগে। দিনের বেলাটা তিনি ঘুরে ঘুরেই কাটান। দুপুরে নিরিবিলি দেখে কোন একটা হোটেলে খেয়ে নেন। ভিড়ভাট্টা তার একেবারেই সহ্য হয় না। রাতে কিছু খান না। কোনদিন একটা কলা, কোনদিন একটা আপেল খেয়ে শুয়ে পড়েন। এক ঘুমে রাত কাবার করে দেন।
আশ্বিন মাসের এক দুপর। বেলা প্রায় দুটা। নুরুজ্জামান সাহেব লালবাগের কেল্লা দেখে একটা হোটেলে ভাত খেতে ঢুকেছেন। হোটেলের নাম দিল্লী রেস্টুরেন্ট। দিল্লী রেস্টুরেন্টের পাশেই আরেকটা হোটেল–হোটেল আমানিয়া। সেখানে রমরমা ভিড়। দিল্লী রেস্টুরেন্ট একেবারেই ফাঁকা। মনে হয় এই হোটেলের খাবার–দাবার সুবিধার না। নুরুজ্জামান সাহেবের কাছে খাবারটা প্রধান না, নিরিবিলিটা প্রধান। কাজেই তিনি ঢুকেছেন দিল্লী রেস্টুরেন্টে। কোণার দিকের অন্ধকারের একটা টেবিলে বসেছেন। ইলিশ মাছ, সবজি এবং ডালের অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। সাধারণত তিনি মাছ খান না। আজ কেন জানি মাছ খেতে ইচ্ছা করল। তখন হোটেলে আরেকজন কাস্টমার ঢুকল। এত ফাঁকা জায়গা থাকতে নুরুজ্জামান সাহেবের কাছে এসে বলল, আপনার টেবিলে বসতে পারি?