কিছু সন্ত্রাসী ভূত আছে। চাদাবাজ। ভদ্রতা বলতে কিছুই জানে না। মানুষ থাকতে যেমন বদ ছিল মরে আরো বদ হয়েছে। অকারণে মারধোর করে।
নিজাম সাহেব আঁতকে উঠে বললেন, সে কি!
পরশুদিনের ঘটনা–একটা পাজেরো গাড়ি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। নতুন গাড়ি দেখে লোভ লাগল। গাড়ির প্রতি আমার আবার একটা দুর্বলতা আছে। বিকেলের দিকে গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে। পাজেরো দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। লাফ দিয়ে গাড়িতে ঢুকে পড়লাম। গাড়ি যাচ্ছিল গুলশানের দিকে। ফার্মগেটেই রেড লাইট। গাড়ি থামছে। আমি বেকুবের মত মাথা বের করেছি। আমাকে দেখেই চার-পাঁচ সন্ত্রাসী ভূত হৈ চৈ করে ছুটে এল। আমি কিছু বোঝার আগেই জানালা দিয়ে টেনে বের করে ফেলল। দিল ধোলাই। এখনো আমার হাতে-পায়ে ব্যথা।
নিজাম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, সর্বনাশ!
অপঘাতে যারা মারা যায় তারাই তো ভূত হয়–অপঘাতে মারা যায় কারা? সন্ত্রাসী-খুনী-চাদাবাজ। আমরা যারা সাধারণ ভূত তারা এদের হাতে জিম্মি। কাওরান বাজারে এক খুনী-ভূত আছে–রামদা হাতে বসে থাকে। কাউকে দেখলেই হুঁ হুঁ হুঁ শব্দ করে রামদা হাতে ছুটে আসে। ভাই সাহেব, কাওরান বাজার এলাকার দিকে ভুলেও যাবেন না।
জি আচ্ছা।
মিরপুর চার নাম্বারেও যাবেন না।
ঐখানে কি?
মিরপুরে আছে দুই ভাই–ছদরুল-বদরুল, দুভাই-ই ভয়ঙ্কর। আমার। ফ্যামিলি থাকে মীরপুরে। দুবছরের উপর হয়ে গেল ওদের দেখতে যেতে পারি। নাই। মন মানে না, দেখতে ইচ্ছ করে–বেকুবের মত একবার চুপি চুপি চলে গেছি, বাসায় উঠার আগেই দুজনের হাতে ধরা পড়লাম। কিরিচের এক কোপে তারা আমার ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলল–তারপর সেই কাটা পা নিয়ে কি খুশি! ফুটবলের মত ছোড়াছুঁড়ি করে। ওরা পা নিয়ে লাফালাফি করছিল, আমি সেই ফাঁকে কোনক্রমে পালিয়ে এসেছি। দুমাস ভুগলাম–দুই মাসে নতুন পা গজাল।
পা গজায়?
তা গজায়। লেজের মত গজায়–ভূত হবার এই এক সুবিধা। যখন পা কাটা গেল তখন জানতাম না পা আবার গজায়। খুব মন-কষ্টে ছিলাম, তারপর একদিন দেখি পা গজিয়েছে। দেখুন না।
ভদ্রলোক পায়জামা পরে ছিলেন। পায়জামা সরিয়ে গজানো পা দেখালেন। এবং নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, গজানো পা আসল পায়ের মত হয় না। দুর্বল হয়–জোর পাওয়া যায় না। তবু যে পা গজায় সেটা কম না। ভূত-জীবনে দুর্ঘটনা লেগেই থাকে। হাত-পা গজানোর সিস্টেম না থাকলে বিরাট বিপদ ছিল।
মাথা গজায়?
মাথা কাটা পড়লে মাথাও গজায়। সেই মাথা সাইজে ছোট হয়।
নিজাম সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, ভাই সাহেব, আপনি কি আমার সঙ্গে একটু আসবেন? একা যেতে ভয়-ভয় লাগছে। মোতালের সঙ্গে সঙ্গে বলল, চলুন। আপনার উপর মায়া পড়ে গেছে। আপনাকে একা ছাড়তেও ইচ্ছা করছে না। ভূত যদি ভূতকে না দেখে, তাহলে কে দেখবে? একটা গান আছে না–ভূত ভূতের জন্যে …
মোতালেব গান ধরল। গলায় সুর বেশ ভাল। একটু নাকি নাকি তারপরও শুনতে খারাপ লাগছে না। কয়েক লাইন গেয়ে বলল, স্যারের গান-বাজনার চর্চা আছে?
জি না।
চর্চা থাকলে ভাল হত। আমাদের সময় কাটে না তো–গান-বাজনা করে সময় কাটাই। চলুন রওনা হই–রিকশায় যাবেন, না গাড়িতে? রিকশায় যাওয়া। ভাল। আপনার তো নিশ্চয়ই চলন্ত গাড়িতে লাফ দিয়ে ওঠার অভ্যাস নেই। শিখে যাবেন। বেঁচে থাকার জন্যে সবই শিখতে হবে। সংগ্রাম করতে হবে। ভূতদের জীবন। হল সংগ্রামী জীবন।
নিজাম সাহেব চমকে উঠলেন। ভূতদের জীবন সংগ্রামী জীবন–তার মানে কি? বেঁচে থাকতে সংগ্রাম, মরার পরেও সংগ্রাম? কি ধরনের সংগ্রাম মোতালেবকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া ভাল।
মোতালেবকে জিজ্ঞেস করা হল না। তার আগেই সে গান ধরল–
আইঁজ পাশা খেঁলবরে ভুতনী
ও ভূতনী তোঁমার সঁনে।
একেঁলা পাইঁয়াছিরে ভূতনী
এই নিঘোর বঁনেঁ…
নিজাম সাহেবের ভাল লাগল। মোতালেবের গলা আসলেই ভাল। তালজ্ঞানও ঠিক আছে। নিজাম সাহেব হাতে তাল দিতে লাগলেন। মোতালেব গান থামাল
স্যার।
জ্বী।
একটা খালি রিকশা যাচ্ছে, চলুন উঠে পড়ি। আমার হাত ধরে লাফ দিন। হাই জাম্প। ছোটবেলায় হাই জাম্প দেননি?
জ্বি না।
ছোটবেলায় হাই জাম্প না দিলেও নিজাম সাহেব ভালই লাফ দিলেন। রিকশার পাটাতনে গড়িয়ে পড়লেন। মোতালেব তাকে সীটে টেনে তুললো। নিজাম সাহেব বললেন–রিকশায় প্যাসেঞ্জার উঠলে আমরা কি করব?
মোতালেব হাই তুলতে তুলতে বলল, কোন সমস্যা নেই। তখন আমরা প্যাসেঞ্জারদের কোলে বসে থাকব। ভূত হবার এও এক মজা। মানুষের কোলে বসে বসে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়।
মানুষের কোলে বসে জীবন কাটিয়ে দেবার ব্যাপারটা নাজিম সাহেবের খুব রুচিকর মনে হল না। তিনি কিছু বললেন না। রিকশার হুড ধরে বসে রইলেন। হঠাৎ তার মনে হল, তিনি পিঠে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করছেন। অস্বস্তিকর ব্যথা। যেন মেরুদণ্ড ধরে কেউ একজন হালকাভাবে তাকে পেছন দিকে টানছে। ব্যথাটা শুরুতে হালকা থাকলেও রিকশা যতই এগুচ্ছে ততই বাড়ছে। মোতালেবকে ব্যাপারটা বলবেন কি না তিনি বুঝতে পারছেন না। ভৌতিক ব্যাপার হয়ত সে অনেক ভাল জানে। রিকশায় চড়লে সব ভূতদেরই হয়ত পিঠে ব্যথা করে। এটাই নিয়ম। ব্যথাটা বাড়ছে, কিছুতেই যাচ্ছে না। ব্যথা কমাবার জন্যে নিজাম সাহেব খুক খুক করে কাশলেন। মোতালেব মাথা ঘুরিয়ে বিস্মিত গলায় বলল, কাশছেন কেন?
কাশি আসছে এই জন্যে কাশলাম। ভূতদের কি কাশা নিষেধ?