নিজাম সাহেব উবু হয়ে বসলেন, মাছ ধরতে গেলেন, ধরতে পারলেন না। আঙুলের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত উপায়ে মাছগুলি বের হয়ে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য ব্যাপার! ঘটনা কি? এর মধ্যে প্রচুর হৈ চৈ শুরু হয়েছে। রাস্তার উপর শত শত লোক জমে গেছে। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে। নিজাম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিয়ে দেখেন–রক্তে রাস্তা ভেসে যাচ্ছে। সেই রক্তে মাখামাখি হয়ে যে শুয়ে আছে সে আর কেউ না, তিনি নিজে।
এই দৃশ্য দেখার পরেও তার বুঝতে কিছু সময় লাগল যে তিনি আসলে মারা গেছেন। অপঘাতে মৃত্যুর পর মানুষ ভূত হয়। তিনিও তাই হয়েছেন। ভূত হয়েছেন। বলেই কেউ তাকে দেখতে পারছে না–তবে তিনি নিজে নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পারছেন। যদিও তার শরীরগত কিছু পরিবর্তন হয়েছে তিনি শিং মাছ ধরতে পারছেন না। মাছগুলি হাতের আঙুল ভেদ করে বের হয়ে যাচ্ছে।
মৃত্যুর আগে তার গায়ে যে পোশাক ছিল, ভূত হিসেবেও তার গায়ে একই পোশাক। এমনকি শিং মাছের পানি লেগে প্যান্ট ভিজে গিয়েছিল–এখনও প্যান্টটা ভেজা। ভেজা প্যান্ট থেকে আঁশটে গন্ধ আসছে। ভূতরা তাহলে গন্ধ পায়? এই রহস্যময় ব্যাপারটার মানে কি কে জানে। তবে কোন রহস্যময় ব্যাপার নিয়ে আপাতত তার মাথা ঘামাতে ইচ্ছা করছে না। মাথা ভো ভো করে ঘুরছে। ধাতস্থ হতে সময় লাগবে। সিগারেট খেতে পারলে হত। ভূতরা সিগারেট খায় কি না তিনি জানেন না।
অ্যাকসিডেন্টের জায়গায় প্রচণ্ড ভিড়। পুলিশ চলে এসেছে। ট্রাফিক পুলিশ পো পে করে বাশি বাজাচ্ছে। কি হয়েছে সবাই এক নজর দেখতে চায়। তিনিও উঁকি দিলেন। এমন ভিড় যে কিছু দেখার উপায় নেই। নিজের ডেডবডি অথচ তিনি নিজে দেখতে পারছেন না। এরচে বড় ট্রাজেডি আর কি হতে পরে? তিনি ফঁক-ফোকর দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগলেন। এই সময় তার পিঠে কে যেন হাত রেখে। বলল, স্যার, আপনিই মারা গেছেন?
নিজাম সাহেব বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, জ্বি।
নিজের মৃত্যুর কথা নিজের মুখে বলতে লজ্জা লাগল।
খুবই আফসোসের কথা। ভেরি স্যাড।
লোকটির কথায় নিজাম সাহেব অভিভূত হলেন। যখন মানুষ ছিলেন তখন এত সহানুভূতি নিয়ে কেউ তার সঙ্গে কথা বলেনি। ভূত হবার পর মানুষের সহানুভূতি পাচ্ছেন, এটা তুচ্ছ করার ব্যাপার না।
স্যার, আপনার নাম কি?
নিজাম। নিজামুদ্দিন।
আমার নাম মোতালেব। আমিও আপনার মত ভূত। ঐ যে টাইলসের একটা দোকান দেখছেন ইউরেকা টাইলস আমি ছিলাম ঐ দোকানের ম্যানেজার।
ও।
দোকানের মধ্যেই পা পিছলে বেকায়দা অবস্থায় পড়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। হাসপাতালে নেবারও সুযোগ হয়নি।
ও।
তারপর থেকে এইখানেই আছি। রাতে দোকানে ঘুমাই।
নিজাম সাহেব আবারও বললেন, ও।
মেইন রোডের উপর দোকান। ট্রাক-ফাঁক সারারাত চলে, ঘুম ভাল হয় না।
ভূতদের ঘুমের প্রয়েজন হয় তার জানা ছিল না। ভূত জগৎ সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানেন না। ধীরে ধীরে সব জানবেন। মোতালেব সাহেবকে পাওয়ায় তার লাভ হয়েছে। সাধারণ জিনিশগুলি তার কাছ থেকে জেনে নেওয়া যাবে।
মোতালেব বলল, এইখানে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করে কি করবেন স্যার, চলে যান।
নিজাম সাহেব বললেন, কোথায় যাব?
ভাবীর কাছে চলে যান। এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, ভাবীর আশেপাশে থাকলেও একটা সান্ত্বনা।
যাব কি ভাবে?
রিকশা করে চলে যান। আপনার তো আর রিকশা ভাড়া লাগবে না। চালু একটা রিকশা দেখে লাফ দিয়ে সীটে উঠে বসে পড়ুন। আপনার বাসা কোথায়?
কলাবাগান।
ঐ দিকে যাচ্ছে এমন একটি রিকশায় উঠে বসুন। আমি অবশ্যি কোথাও যেতে হলে গাড়িতে করে যাই। তবে রিকশার আলাদা মজা আছে।
নিজাম সাহেব চুপ করে আছেন। এত দিন ভেবেছিলেন ভূতরা বাতাস হয়ে ঘুরে বেড়ায়–এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাপার সে রকম নয়। চলাফেরার জন্যে তাদেরও রিকশা, বেবীটেক্সি লাগে।
মোতালেব বলল, স্যারের মনটা এত খারাপ কেন?
নিজাম সাহেব বললনে, না না, মন খারাপ না। একটু ইয়ে লাগছে। কথা নেই। বার্তা নেই হঠাৎ ভূত হয়ে গেলাম।
মোতালেব বলল, একটু ইয়ে তো লাগবেই। শুধু একটু না, অনেকটু ইয়ে লাগবে। আধঘণ্টা আগেও ছিলেন মানুষ, এখন হয়েছেন ভূত। আমি যখন প্রথম ভূত হই–কি অভিজ্ঞতা! কি করব না করব কিছুই জানি না। তখন ছিল ঘোর বর্ষা, বুঝলেন ভাই সাহেব। আমি বেকুবের মত সারারাত বৃষ্টিতে ভিজলাম। তার কোন প্রয়োজন ছিল না। ইচ্ছা করলেই যে কোন বাড়িতে ঢুকে যেতে পারতাম। আমরা হলাম ভূত–দরজা বন্ধ থাকুক বা না থাকুক, আমরা যে কোন ফুটোফাটা দিয়ে ঢুকতে পারি, তাই না?
কিছু না বুঝেই নিজাম সাহেব বললেন, জ্বি।
বুঝলেন ভাই সাহেব, যেহেতু কিছুই জানি না–সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে আমার হয়ে গেল সর্দি। বুকে কফ বসে গেল–খকর খকর করে কাশি।
নিজাম সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, ভূতদের সর্দি হয়?
মোতালেব বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যাঙের যদি সর্দি হতে পারে, ভূতের হবে না। কেন? আমরা কি ব্যাঙের চেয়েও খারাপ?
নিজাম সাহেব কিছু বললেন না। তার মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। মোতালেব বলল, শুধু শুধু দেরি করছেন কেন স্যার? চলে যান। ভাবীর পাশে বসে থাকুন। আপনার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানোর পর ভাবী আছাড়-পিছাড় খেয়ে কাদবে। ঐ দৃশ্য দেখে খুব মজা পাবেন। একটা রিকশা নিয়ে চলে যান। তবে চোখকান খোলা রাখবেন–একটু কেয়ারফুল থাকবেন।
কেয়ারফুল থাকব কেন?