ফুলবানুকে শান্ত করার জন্যে সেই রাতেই মোবারককে বিদায় করতে হল। ফুলবানুর অস্থিরতা তাতে কমল না। আরো বেড়ে গেল। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হল। তার কষ্ট চোখে দেখা যায় না। চান্দ শাহ ফকিরের চোখে পানি এসে গেল। সে গুণীন মানুষ। গুণীন মানুষের চোখে পানি আসা ভয়ংকর ব্যাপার। মন্ত্রের জোর বলে কিছু থাকে না। কিন্তু সে চোখের পানি সামলাতে পারছে না।
ফুলবানু স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, কানতেছেন ক্যান? পুলাপানের মত চিক্কর দিয়া কান্দন। ছিঃ ছিঃ! মানুষ হইয়া জন্মাইছি, রোগ হইব। ব্যাধি হইব–একদিন মরণ হইব। কান্দনের কি? চউখ মুছেন।
চান্দ শাহ চোখ মুছল। সেই চোখ সঙ্গে সঙ্গে জলে ভর্তি হয়ে গেল। ফুলবানু অতি কষ্টে শ্বাস টানতে টানতে বলল, আফনে আমার সামনে থাইক্যা যান। আমার সামনে বইস্যা আফনের কষ্ট হইতেছে।
কই যাব?
ছাতিম গাছের তলে গিয়ে বসেন।
কি যে তোমার কথা!
আমার কথা ঠিক আছে। আপনে যান কইলাম–এক্ষণ যান। শইলডা একটু ভাল বোধ হইলে ডাক দিব।
বউ। আবার কথা?
চান্দ শাহ ফকির হুঁকা হাতে ছাতিম গাছের নিচে বসল। কৃষ্ণপক্ষের মরা চাদ উঠেছে। চারদিকে গা ছমছমা আলো। ঘরের ভেতর থেকে ফুলবানুর কাতরানি শোনা যাচ্ছে। এমন সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। চান্দ শাহ ফকিরকে চমকে দিয়ে কে একজন মিষ্টি গলায় ডাকল–ফকির সাব। চান্দ শাহ চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। ভয়ে সে অস্থির হয়ে গেল। ফুলের গন্ধে চারদিক ম-ম করছে। কোত্থেকে আসছে এত মিষ্টি সুবাস?
কে, কে? কে কথা বলে?
মিষ্টি গলা আবার শোনা গেল–এওমা, ভয়ে আপনি দেখি আমরা। যে দিন-রাত জ্বীন-সাধনা, পরী সাধনার কথা বলে তার এমন ভয় পেলে চলে?
আপনে কে?
আমি পরী।
চান্দ শাহ হতভম গলায় বলল, পরী বইল্যা দুনিয়ায় কিছু নাই।
ওমা, আজ দেখি উল্টা কথা।
উল্টা না, এইটা সত্য।
এইটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমার কথা কিভাবে শুনছেন?
রোগে-শোকে, অভাবে-অনটনে মনের মধ্যে ধান্ধা লাগছে। ধান্ধার কারণে কথা শুনতেছি। আসলে কিছু না।
ভাল করে তাকান। তাকিয়ে দেখেন তো কি ব্যাপার।
চান্দ শাহ ফকির ভাল করে তাকালো। আরে তাই তো, তার সামনে একটা পরীই তো দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে কিশোরী মেয়েদের মত। শুধু চোখ দুটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। পাখা আছে–পাখা দুটা অল্প অল্প কাঁপছে। ফুলের গন্ধ আসছে পরী মেয়েটার গা থেকে। কি অদ্ভুত গন্ধ আর কি সুন্দর মেয়েটার মুখ! পরী ঠোট টিপে হাসতে হাসতে বলল, দেখলেন?
চান্দ শাহ কিছু বলল না। বলবে কি? সে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছে। পরী আবার কি?–কি, মুখে দেখি বাক্য নেই। বিনা আগুনে হুক্কা টানছেন। হুক্কায় আগুন দেয়ার কেউ নেই। মোবারক চলে গেছে?
জি।
ঘরে এমন রোগী, জীবন-মরণ ব্যাপার। আর মোবারক চলে গেল?
চান্দ শাহ কি বলবে ভেবে পেল না। শরীর বন্ধন মন্ত্রটা কি পড়বে? পড়ে ফেলা দরকার। এই পরী মেয়েটার কাণ্ডকারখানা ভাল ঠেকছে না। যদিও মন্ত্র-তন্ত্র বলে। কিছু নেই। নেই-ই বা বলা যায় কি ভাবে? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে পাখাওয়ালা পরী। কি আজিব কাণ্ড!
চান্দ শাহ ফকির।
চান্দ শাহ জবাব দিল না। শরীর বন্ধন মন্ত্র মনে করার চেষ্টা করতে লাগল–
দোহাই দোহাই
তিন পীর।
কিরপিন সবে নীর।।
লক্ষ্মী ও মনসা।
মা কালী ভরসা।
দিলাম দেহ বন্ধন
রক্ত বর্ণ চন্দন।।
ফুলের নাম জবা।
পশ্চিমে রয় কাবা।
কাবার ঘরে ছয় কুঠুরী …
পরী খিলখিল করে হেসে উঠল। চান্দ শাহ ফকিরের মন্ত্রে গণ্ডগোল হয়ে গেল। দেহ বন্ধন মন্ত্র দীর্ঘ মন্ত্র। একবার আউলা লেগে গেলে গোড়া থেকে পড়তে হবে।
চান্দ শাহ ফকির বিড়বিড় করে কি পড়ছেন? মন্ত্র?
জ্বি।
কি মন্ত্র? দেহ বন্ধন?
হুঁ।
মন্ত্র-তন্ত্র বলে কিছু আছে?
জ্বি না।
তাহলে পড়ছেন কেন?
আপনে কে?
একবার তো বললাম। আবার বলতে হবে? আমি পরী।
ও আচ্ছা।
আমি আপনার বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম, আপনার চোখের পানি দেখে নেমে এলাম। কাদছিলেন কেন?
চান্দ শাহ চুপ করে রইল। বলবেই বা কি? বলার মত কোন কথা কি আর আছে।
শুনুন চান্দ শাহ, আমার হাতে একেবারে সময় নেই। আমি এক্ষুণি চলে যাব। তবে নেমেছি যখন, তখন আপনার একটা ইচ্ছা পূরণ করব। বলুন কি চান? যা চান তাই পাবেন। তবে একটা মাত্র জিনিশ। বলে ফেলুন? এক কলসী সোনার মোহর দিলে হবে? এক কলসীর জায়গায় সাত কলসীও দিতে পারি। তবে ধনদৌলত বেশি হলেও সমস্যা হয়। দেব এক কলসী মোহর?
জ্বি না।
ধনদৌলত চান না। তাহলে কি চান? সম্মান? লোকজন আপনাকে দেখেই সালাম করবে। যত বড় মানুষই হোক, আপনাকে দেখে উঠে দাঁড়াবে?
জি না।
বাকি রইল কি–ক্ষমতা। ক্ষমতাও খুব ভাল জিনিশ। ধনদৌলত, সম্মানের চেয়ে ক্ষমতা অনেক মধুর–ক্ষমতা চান?
জ্বি না। আপনে ফুলবানুরে ভাল কইরা দেন।
উদ্ভট কথা বলেন কি ভাবে। ফুলবানুরে আমি ভাল করব কি ভাবে? আমি কি ডাক্তার–মেডিকেল কলেজের ডিগ্রী আছে আমার? আপনাকে বুদ্ধিমান লোক বলে ভেবেছিলাম–এখন তো দেখছি আপনি বোকা। মহা বোকা। ফুলবানু যে দজ্জাল, ভাল হয়ে গেলে আপনকে তো কচলে ফেলবে।
কচলাইলেও ক্ষতি নাই।
কচলালেও ক্ষতি নেই? তাহলে তো ভাল করে দিতেই হয়। আচ্ছা ঠিক আছে দিচ্ছি ভাল করে। যান, ঘরে যান, ঘরে গিয়ে দেখুন। আর আমি বিদায় হচ্ছি।
পাখির ডানা ঝাপ্টানোর মত শব্দ হল। হতভম্ব চান্দ শাহ ফকিরের চোখের সামনে পরী আকাশে উঠে গেল। পরী চলে গেলেও তার গায়ের গন্ধ এখনো রয়ে গেছে। ঘরের ভেতর থেকে ফুলবানু ডাকল–এই যে ফকির সাব, শুইন্যা যান।